ই-কমার্স 'ইনফিনিটি'র অন্তহীন প্রতারণা

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১১:৩৮, মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০২২, ১৫ ভাদ্র ১৪২৯

'ঘরে বসে বাজার নিয়ে চিন্তিত? সমাধান এখন এক ক্লিকেই'- ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইনফিনিটি মার্কেটিং লিমিটেডের স্লোগান এটা। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। পণ্য বিক্রির নামে অর্থ আদায় করার পরও যথাসময়ে সরবরাহ না করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্তরা। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

তদন্ত সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নেয় প্রতিষ্ঠানটি। লাইসেন্সে ব্যবসার ধরন হিসেবে মার্কেটিং, সরাসরি বিক্রয়, এমএলএম, আমদানি-রপ্তানি, সরবরাহ ও বিপণনের কথা বলা হলেও প্রতিষ্ঠানটি ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনা করেছে। বিএফআইইউর প্রতিবেদনের পর এখন ইনফিনিটির প্রতারণা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মানি লন্ডারিং আইনে মামলারও প্রস্তুতি চলছে। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

ইনফিনিটি মার্কেটিং লিমিটেডের কর্ণধার সিরাজুল আমিন ও তাঁর স্ত্রী শারমিন আফরোজ। প্রতিষ্ঠান ও তার স্বার্থসংশ্নিষ্টদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ৫৮টি হিসাব নম্বর রয়েছে। এসব নম্বরে ৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা জমা ও সমপরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হয়। এসব হিসাব নম্বরের মধ্যে এক কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে ১৭টি হিসাবে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানের নামে পরিচালিত হিসাব নম্বর দুটি।

তদন্তে বলা হয়েছে, বিভিন্ন গেটওয়ে থেকে ৪৯ লাখ ৫ হাজার টাকা ইনফিনিটির সিটি ব্যাংক, ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের হিসাবে জমা হয়। বিভিন্ন গ্রাহকের কাছে পণ্য বিক্রির নামে এ অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিকাশের মার্চেন্ট হিসাব নম্বরে (০১৬৭৮৭৫১৮৩৯) প্রায় ১১ লাখ ২১ হাজার টাকা গ্রাহকের কাছ থেকে জমা হয়। তার মধ্যে ১০ লাখ ৯ হাজার টাকা বিকাশের এজেন্ট পয়েন্টের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়। ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালিত একটি হিসাব নম্বরে (১৯১১১০০০০৮৫৬৩) ৮ জন ব্যক্তি চেকের মাধ্যমে ৩৬ লাখ ১২ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন। ইনফিনিটির সঙ্গে টাকা উত্তোলনকারী ওই ব্যক্তিদের পরিচয় সম্পর্কে জানা যায়নি। এ অর্থ উত্তোলনকারীদের মধ্যে রয়েছেন মোবারক, আমিন, ইব্রাহিম, সাহাবুদ্দিন ও শরিফুল। এ ছাড়া ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডে ইনফিনিটি এইচসিএম লিমিটেডের হিসাব নম্বরে (২৪৬১১০০০০৫৬৪২) ২৫ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়। এই অর্থ পরে উত্তোলন করা হয়। এ ছাড়া নগদের একটি মার্চেন্ট আইডি (০১৬৭৮৭৫১৮৩৯) থেকে ৪১ লাখ টাকা জমা হয়েছে।

ইনফিনিটি মার্কেটিং লিমিটেডের ফেসবুক পেজে গিয়ে দেখা যায়, গুলশান অ্যাভিনিউ-১-এর জব্বার টাওয়ারে এর কার্যালয়। সেখানে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে একটি নম্বর দেওয়া আছে। ওই নম্বরে যোগাযোগ করা হলে শাহাবুদ্দিন নামে একজন কল রিসিভ করেন। প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, ওয়েবসাইটের নতুন ডিজাইন করার কারণে আপাতত তাঁরা ই-কমার্স কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন। ২০১২ সালে তাঁরা ই-কমার্স শুরু করেন। এখন সুইজারল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠানের পণ্য তাঁরা বিক্রি করছেন। ইনফিনিটির কর্ণধার সিরাজুল আমিনের মোবাইল ফোন নম্বর চাইলে তিনি মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরে দেবেন বলে জানান। প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজের 'লাইক' ও 'ফলোয়ার' সংখ্যা ৫ হাজারের কাছাকাছি।

প্রতারণার ব্যাপারে শাহাবুদ্দিনের ভাষ্য, 'গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণার বিষয়টি আমার জানা নেই। আমরা টাকা পেলে পণ্য বিক্রি করি।'

রাতে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে বিদেশে অবস্থানরত ইনফিনিটির কর্ণধার সিরাজুল আমিন বলেন, 'এতগুলো হিসাব নম্বরের তথ্য জানা নেই।' বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন কীভাবে হলো, তা নিয়ে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, 'নতুন করে আমরা ই-কমার্সভিত্তিক ব্যবসা শুরু করব। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করেও কভিডের সময় বন্ধ করা হয়েছিল। যদি নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটে থাকে তাহলে কোনো প্রতিষ্ঠান ডাকলে আমরা জবাব দেব। আর ই-কমার্স ছাড়াও আমাদের আরও ব্যবসা আছে।'

ই-কমার্স বন্ধ রাখার দাবি করলেও প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ধরনের পণ্যের ছবি রয়েছে। ২০২০ সালের ৫ অক্টোবরের একটি পোস্ট এখনও সেখানে আছে। সেখানে বলা হয়, 'অতি আনন্দের সঙ্গে জানানো যাচ্ছে যে, সর্বসাধারণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, সময় ও পণ্যের গুণগত মানের কথা মাথায় রেখে ইনফিনিটি গ্রুপ তাদের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। সর্বসাধারণের দৈনন্দিন চাহিদা, পুষ্টি, স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাজারে নিয়ে এসেছে কিছু বিশেষ ধরনের পণ্য। এই প্ল্যাটফর্মেই পাবেন সাধ্যের মধ্যে গুণগত মানের সর্বোৎকৃষ্ট পণ্য। এই অগ্রযাত্রায় সঙ্গে থাকার জন্য ইনফিনিটি ই-কমার্সের সকল ভোক্তা, ব্যবসায়িক সহযোগী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতি রইল আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা।'

তদন্ত হচ্ছে ওয়ালমার্ট ইলেকট্রনিকস ঘিরে :ই-কমার্সভিত্তিক আরেক প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস লিমিটেডের প্রতারণা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে সিআইডি। এর মধ্যে বিএফআইইউর তদন্তে এ প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম ও জালিয়াতির তথ্য উঠে এসেছে। সেই তদন্তের পর এখন মানি লন্ডারিং মামলার প্রস্তুতি চলছে। এ প্রতিষ্ঠানটি সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নেয় ২০২০ সালের ১৬ আগস্ট। যে শর্তে তাদের লাইসেন্স দেওয়া হয়, তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ব্যবসার ধরন বদলে ফেলে তারা। ওয়ালমার্টের এমডি হলেন শেখ ফরিদ আহমেদ ও পরিচালক রুনা বেগম। বিভিন্ন ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানে তাঁদের পরিচালিত ২৯টি হিসাব নম্বরে ৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা জমা হয়। প্রায় সমপরিমাণ অর্থ তাঁরা উত্তোলন করে ফেলেন। শেখ ফরিদ কোম্পানির হিসাব নম্বর থেকে ১৮ লাখ ৪৫ হাজার টাকা নগদ তুলে নেন। এই লেনদেন ই-কমার্স ব্যবসার সঙ্গে সামঞ্জ্যপূর্ণ নয়। এই অর্থ অন্য খাতে স্থানান্তর হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া একই কোম্পানির হিসাব নম্বর থেকে আরও ২০ জন নগদ ও ক্লিয়ারিং চেকের মাধ্যমে ১ কোটি ৪৪ লাখ ৫৬ হাজার টাকা তুলেছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন আহমদুল হক খন্দকার, একেএম কামরুজ্জামান, আবু বকর শেখ, ফাহিম আহমেদ, হাবিবুর রহমান, মাহাবুবুর রহমান, মনির হোসেন খান, সাইফুল ইসলাম, তরিকুল ইসলাম ও তসলিম উদ্দিন।

ই-কমার্স খাত ঘিরে নৈরাজ্য শুরু হলে ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকাসহ অন্তত ১৫টি কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ৪০টি মামলা রয়েছে। এগুলো তদন্ত করছে সিআইডি, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ ছাড়া এই খাত শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে ১৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এ ছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল দুটি আলাদা কমিটি করে। এর একটি হচ্ছে কারিগরি কমিটি, যার লক্ষ্য ডিজিটাল কমার্স-সংক্রান্ত কার্যক্রম, ডিজিটাল কমার্সের মাধ্যমে ব্যবসা, লেনদেনজনিত ভোক্তা বা বিক্রেতার অসন্তোষ, প্রযুক্তিগত সমস্যা নিরসন করা। আরেকটি কমিটি দেখছে ই-কমার্স আইন ও ই-কমার্স কর্তৃপক্ষ গঠনের বাস্তবতা আছে কিনা।

পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ই-কমার্স ঘুরে দাঁড়াক- এটা সবাই চায়। তবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য সার্বক্ষণিক নজরদারিও জরুরি। প্রতারণা করে গ্রাহক ও ভোক্তার অর্থ নিজস্ব সম্পদে রূপ দিচ্ছে; কেউ আবার পাচার করছে।

Share This Article

শনিবার ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ: মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল

চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড

তাপপ্রবাহ নিয়ে সুখবর দিলো আবহাওয়া অফিস

নিজের প্রচারের স্বার্থে অন্যকে ব্যবহার ব্যক্তিত্ব বিলিয়ে দেওয়া: অপু

থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ নথি সই, চিকিৎসা খাতে বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী

যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন ঢাকার প্রত্যাখ্যান

চলতি বছরই থাইল্যান্ডের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আশা প্রধানমন্ত্রীর

দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, বিএনপি দেখে না: কাদের

মার্কিন চাপ নয়, যুদ্ধ পুরোপুরি বন্ধ হলেই জিম্মি মুক্তি দেবে হামাস