সাড়ে তিন বছরের চিত্র

বন্ধ জুটমিল ‘পাহারায়’ব্যয় প্রায় ২শ কোটি

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:০২, শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ১১ ফাল্গুন ১৪৩০

কালবেলা: খুলনায় সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় বন্ধ থাকা ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত জুটমিলের পাহারায় সরকারের ব্যয় হয়েছে ১৮৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে বিদ্যুৎ ও কর্মকর্তাদের যানবাহনের জ্বালানি ব্যয় হয়েছে ৩২ কোটি ৮২ লাখ টাকা। বন্ধ মিলের গেট, তালাবদ্ধ গোডাউন এবং ভেতরের যন্ত্রপাতিতে মরিচা ধরলেও এসব মিলের ৯৬১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিষয়ে সুরাহা হয়নি। এমনকি গত ডিসেম্বরে বেসরকারি দুটি প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে মিল চালু করলেও সেখানে থাকা ১৭২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীও বেতন পাচ্ছেন সরকারিভাবে। একে সরকারি অর্থের অপচয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন মিলগুলোর সাবেক শ্রমিকরা। আর রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় বিশাল আয়োজন থাকলেও চোর ও পাহারাদারের যোগসাজশে প্রতিনিয়ত চুরি হচ্ছে মিলের মূল্যবান যন্ত্রপাতি।

খুলনার বন্ধ ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত জুটমিল ঘুরে দেখা যায়, বন্ধ মিলের প্রধান ফটক, তালাবদ্ধ রয়েছে গোডাউন আর তার মধ্যে মরিচা পড়েছে উৎপাদন যন্ত্রপাতিতে। এক সময়ের শ্রমিকের পদচারণায় ও যন্ত্রপাতি চলার শব্দে মুখর থাকত যে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো, সেখানে এখন সুনসান নীরবতা। এসব মিলে সর্বশেষ সাইরেন বেজেছে ২০২০ সালের ৩০ জুন। বন্ধের কারণে চাকরি হারান প্রায় ৩৩ হাজার ৩০৬ শ্রমিক। তার মধ্যে স্থায়ী শ্রমিক ছিলেন ১৫ হাজার ৩০ এবং অস্থায়ী (বদলি) শ্রমিক ১৪ হাজার ২৭৬ জন। এ ছাড়া খালিশপুর ও দৌলতপুর জুট মিলে দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক ছিলেন প্রায় ৪ হাজার। এরপর ২০২১ সালের এপ্রিলে রাষ্ট্রায়ত্ত এসব মিল বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দিতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর মধ্যে ফরচুন গ্রুপকে খুলনার দৌলপুর জুটমিল এবং জেজেআই জুটমিলকে দেওয়া হয়েছে আকিজ গ্রুপের কাছে। কোনো উৎপাদন না থাকলেও এখানে রয়েছে উৎপাদন কর্মকর্তা, কাঁচা পাট ক্রয় না থাকলেও বসে বসে বেতন নিচ্ছেন ক্রয় কর্মকর্তা, আছে মান নিয়ন্ত্রণ, বাজারজাতকরণ কর্মকর্তা, শ্রমিক না থাকলেও শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য রয়েছে চিকিৎসক, আছে কারখানা তদারকি কর্মকর্তাও, যাদের বসে বসে বেতন নেওয়া ছাড়া কোনো কাজ নেই।


প্লাটিনাম জুটমিলের শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীর বলেন, এখানে উৎপাদন না থাকলেও উৎপাদন কর্মকর্তা আছে, ক্রয় না থাকলেও ক্রয় কর্মকর্তা, স্টোরে মাল নেই; কিন্তু স্টোর কর্মকর্তা আছে। শ্রমিকদের ছাঁটাই করে কোনো কারণ ছাড়া কাজ না করিয়ে বড় বাবুদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেওয়া হচ্ছে। সরকার কেন রাষ্ট্রের এত বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রতি মাসে ব্যয় করে জানি না।

বিজেএমসি থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, খুলনার ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত জুটমিলের মধ্যে সব থেকে বেশি কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছে ক্রিসেন্ট জুটমিলে, সেখানে কর্মকর্তা ৭৫ এবং কর্মচারী রয়েছেন ১০২ জন। এ ছাড়া আলিম জুটমিলে ২০ কর্মকর্তা ও ২৪ জন কর্মচারী, কার্পেটিং জুটমিলে ৪২ কর্মকর্তা ও ২১ কর্মচারী, দৌলতপুর জুটমিলে ২১ কর্মকর্তা ৪৯ কর্মচারী, ইস্টার্ন জুটমিলে ২৩ কর্মকর্তা ও ৫৫ কর্মচারী, জেজে আই জুটমিলে ৩৭ কর্মকর্তা ও ৬৫ কর্মচারী, খালিশপুর জুটমিলে ৪৪ কর্মকর্তা ও ১০২ কর্মচারী, প্লাটিনাম জুটমিলে ৫৮ কর্মকর্তা ও ১০২ কর্মচারী, স্টার জুটমিলে ৪০ কর্মকর্তা ও ৮১ জন কর্মচারী রয়েছেন। এই ৩৬০ কর্মকর্তা ও ৬০১ কর্মচারীর বাইরে জুটমিলগুলোর নিরাপত্তায় নেওয়া হয় আরও ৮২ জন আনসার। প্রতি মাসে তাদের বেতন দিতে হচ্ছে ১৩ লাখ ৪৩ হাজার টাকা।

এদিকে বিজেএমসি থেকে পাওয়া মিলগুলোর খরচের খাত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মূলত, কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন, মিলগুলোর বিদ্যুৎ বিল ও জালানি খরচ হিসেবে ব্যয় করে থাকে। বিশাল এই লটবহরের পেছনে সরকারের প্রতি মাসে ব্যয় হয় সাড়ে ৪ কোটি টাকা। শুধু বেতন বাবদ খরচ হয় ৩ কোটি, ৭০ লাখ ৪৭ হাজার টাকা, বিদ্যুৎ বিল ২১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, জ্বালানি ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য খরচ রয়েছে ৫৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। এই ৯টি জুট মিলের মধ্যে গত ডিসেম্বরে বেসরকারি দুটি প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে মিল চালু করলেও সেখানে থাকা ১৭২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীও বেতন পাচ্ছেন সরকারিভাবে।

দৌলতপুর জুটমিলের শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য আবুল কাশেম বলেন, এখানে পাট ছিল, কোটি কোটি টাকার পণ্য টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে, মিলের সব মালপত্র লুটপাট হয়ে যাচ্ছে।

তবে মিল পাহারার নামে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থের ব্যয় হলেও সুরক্ষা মেলেনি রাষ্ট্রীয় সম্পদের, চোর পাহারাদার যোগসাজশে মিলের মূল্যবান যন্ত্রপাতি লোপাট হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। টিআইবির খুলনার সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত ই খুদা কালবেলাকে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে বিজেএমসি তাদের বেতন দিচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে, এই মিল আর চালু করা সম্ভব হবে না। এখানে শুধু মিল বন্ধ হয়নি। অসৎ কর্মচারীরা এখানে মেশিন পার্টস লুট করছে।

এদিকে বন্ধ মিলের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষায় কর্মকর্তা কর্মচারীরা কাজ করছে বলে দাবি করছেন বিজেএমসির আঞ্চলিক সমন্বয়কারী গোলাম রব্বানী। ২০২০ সালের ৫ জুলাই থেকে এখানকার কর্মকর্তা কর্মচারীরা এখানে পর্যাক্রমে রাতে পাহারা দেয়। আজ পর্যন্ত কোনো মিলের কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি।

 

বিষয়ঃ বাংলাদেশ

Share This Article