দাঙ্গা বাঁধানোর উদ্দেশে মৃতের তালিকায় জীবিত, এটাই কি মানবাধিকার?

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ বিকাল ০৫:৫৬, বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ৫ আশ্বিন ১৪৩০

বাকস্বাধীনতা কি সীমাহীন? প্রশ্নটা অতি পুরোনো। আবার বাকস্বাধীনতার নামে যা ইচ্ছা তা প্রচার করাটাও নতুন কিছু নয়। বাকস্বাধীনতার নামে কতটা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারা যাবে? এখানে দুটি মতাবলম্বীর দেখা পাওয়া যায়। একদল স্পষ্ট বলছে- আমার বাকস্বাধীনতা মানে আমি যা ভালো মনে করবো, প্রয়োজন মনে করবো, তাই প্রকাশ করবো।

আরেকটি পক্ষের কথা- আপনি অবশ্যই আপনার মত প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু এর অর্থ এই নয় লাগামহীন কিছু বলার স্বাধীনতা আপনাকে রাষ্ট্র দিতে পারে। লাগামহীন স্বাধীনতা যা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এমনকি কখনো কখনো সার্বভৌমত্বকেও আঘাত করতে পারে এই বাকস্বাধীনতা অবশ্যই কোনো রাষ্ট্র কাউকে দিতে পারে না।

পশ্চিমারা মানবাধিকার মানবাধিকার বলে চিৎকার করে, আর তাদের টার্গেটেড দেশ ও জাতির ওপরই এটা চাপিয়ে দেয়। কিন্তু নিজেদের মধ্যেই এমন দেশও আছে যেখানে বছরের পর বছর বর্ণবাদের কারণে মানুষ খুন হয়, বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করা হয় প্রকাশ্যে। স্কুলে ঢুকে কচিপ্রাণ সংহার করা হয় ব্রাশ ফায়ারে। সেখানে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে দেখে না

বাকস্বাধীনতার নামে যদি সামাজিক উত্তেজনা তৈরি করা হয়, যদি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেওয়া হয়, তখনও কি তাকে মৌলিক অধিকারভুক্ত করা যাবে? জবাবটা স্পষ্ট সবার কাছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক উসকানি সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারীকে ইন্দনদাতার অভাব হয় না। শুধু দেশেই নয়, বিদেশি একটি মহলও বসে থাকার নয় যেন।

সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার কথা। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি আদালত ‘অধিকার’ নামে একটি সংগঠনের দুই শীর্ষ নেতা যথাক্রমে আদিলুর রহমান শুভ্র এবং এ এস এম নাসিরুদ্দীন এলানকে দুই বছরের কারাদণ্ড প্রদান করায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের এই প্রস্তাবে বোঝা যায়, আদিলুর রহমানের বিরুদ্ধে বিচার হওয়াটা অন্যায় বলে মনে করছে তারা। শুধু তাই নয়, তারা সুস্পষ্টভাবে এর মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে।

তাদের এই বোধ এর পেছনে কি মানবাধিকারের লেশ মাত্র আছে? প্রশ্নটা করা যায়, ঘটনার সূত্রপাত বিশ্লেষণ করে। এই অধিকার এর দুই শীর্ষ নেতাকে এমন অভিযোগে বিচার করা হলো যে অভিযোগ ছিল মানবতাবিরোধী। তাইলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কি মানবতাবিরোধী অবস্থানকেই মানবতাবাদী হিসেবে বিশ্বাস করেন। প্রাসঙ্গিকভাবে অধিকারের বিষয়টি পর্যালোচনা হতে পারে। ২০১৩ সালে উগ্র ধর্মীয় সম্প্রদায় হেফাজতে ইসলাম রাজধানীর শাপলা চত্বরে তাণ্ডব চালায়।

সেই তাণ্ডবকালে পুলিশের হাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে বলে কিছু রাজনৈতিক দল গুজব ছড়ায়। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে একেক নেতা একেকবার একেকরকম তথ্য পরিবেশন করে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করেন। তাদের কাছ থেকে শত শত এমনকি হাজার হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছে বলা হয়। কিন্তু প্রমাণাদি দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ২০১৩ সালের ৫ মে ঘটনার পরপরই হেফাজতে ইসলাম ঘোষণা করে তারা শিগগির নিহতদের তালিকা জনসমক্ষে উপস্থাপন করবে। কিন্তু ১০ বছরেও সেই তালিকা তারা উপস্থাপন করতে পারেনি। যখনই তাদের এ বিষয়ে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছেন, তখনই তারা বলেছেন তালিকা তৈরি হচ্ছে।

হেফাজতে ইসলামের নেতাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে মতিঝিল এলাকা তছনছ করে ফেলা হলো। শত শত দোকানপাট ভেঙে, লুট করে, জ্বালিয়ে দিয়ে মহাতাণ্ডব তৈরি করে তারা। তাদের হাত থেকে নারী সাংবাদিকও রেহাই পাননি। এমনকি বায়তুল মোকাররমে কোরআন শরিফও তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। জ্বালিয়েছে ওরা।

এসব প্রত্যক্ষ করেছে সাধারণ মানুষ। তাণ্ডবগুলো সরাসরি গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে। কিন্তু তাদের তাণ্ডবকে দমনে পুলিশ বাহিনীর কথিত নৃশংসতা কেউ দেখেনি। একটি মোবাইলের তোলা ছবিও আজ পর্যন্ত কেউ প্রকাশ করতে পারেনি, যা দেখা গেছে, হেফাজতের কর্মীরা হাত উঁচিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার দৃশ্য।

পরদিন সকালে চিটাগাং রোড এলাকায় মসজিদের মাইকে ঘোষণা করা হয়, মাদরাসায় পুলিশ হামলা করেছে। মাদরাসা রক্ষায় যেন মানুষ এগিয়ে আসে। ধর্মীয় উম্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে সেই গুজবে। মানুষকে বলা হয় সড়ক অবরোধ করতে, কথিত আক্রান্ত মাদরাসা রক্ষার্থে কাউকে আহ্বান জানানো হয়নি। শত শত মাদরাসাছাত্র ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে আবারও তাণ্ডব চালায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী সেখানে হস্তক্ষেপ করে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দুই সদস্যসহ কয়েক ব্যক্তি সেখানে মারা যায়।

তাদের নাম-ঠিকানা জেনেছে মানুষ। কিন্তু শাপলা চত্বরে কথিত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে হেফাজত কিংবা তাদের সমর্থনকারী বিএনপি কেউই কথিত নিহতদের কোনো নাম-ঠিকানা দিতে পারেনি। কিন্তু ওই সময় ‘অধিকার’ নামের একটি এনজিও তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে, সেদিন শাপলা চত্বরে ৬১ জন নিহত হয়েছে।

হেফাজতে ইসলাম কোন দাবিতে সেখানে জড়ো হয়েছিল, তাদের দাবি যৌক্তিক কি না সেই প্রশ্ন ছাড়াই বলা যায়, ৬১ জন মানুষের প্রাণহানি হলে, সেটা হতো কলঙ্কিত দৃষ্টান্ত। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অধিকার যে ৬১ জনের কথা বলেছে, তা যে ভুয়া তা প্রমাণ হয় পরবর্তীকালে তদন্ত করতে গিয়ে। এতবড় একটি ঘটনার পর সরকারকে অবশ্যই তদন্ত করা জরুরি হয়ে পড়ে। তারা কথিত নিহতদের তালিকাটি অধিকারের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চায়।

কিন্তু অধিকার সেই তালিকা সরকারকে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সরকার অধিকারের অফিস থেকে কম্পিউটার জব্দ করে। সেখানে এই ৬১ জন কথিত নিহতের তালিকা পায়। এই তালিকায় এক দুজন নয়, চারজনকেই জীবিত পাওয়া যায়। কতটা অবিবেচক ও উচ্ছৃঙ্খলতা তৈরির উদ্দেশ্য থাকলে জীবিত মানুষকে মৃতের তালিকায় প্রকাশ করতে পারে?

শুধু তাই নয়, পাঁচজনের নাম দুবার করে লিখে মৃতের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। অন্য ঘটনায় নিহত ছয়জনকে শাপলা চত্বরে নিহত হয়েছে বলা হয়। সাতজন ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ পরিচয়ই ছিল না। ১১ জন ছিল ভুয়া ব্যক্তি। তাদের কোনো সংযোগই ছিল না শাপলা চত্বরের ঘটনার সঙ্গে। ভুয়া মৃতের তালিকা প্রকাশকালে ‘অধিকার’ তাদের ওয়েবসাইটে ‘হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন' শিরোনাম ব্যবহার করে।

সঙ্গত কারণেই বলা যায়, ‘অধিকার’ যা করেছে তা মানুষকে উত্তেজিত করে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রয়াস। এ ধরনের মিথা প্রচারণায় দেশ-বিদেশে রাষ্ট্রের দুর্নামও ছড়িয়েছে। বরং দাঙ্গা বাধানোর অপচেষ্টা করে তারাই মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। মিথ্যাচার ও গুজব ছড়িয়ে মানবাধিকারের নামে উচ্ছৃঙ্খল সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর অপচেষ্টাকে কি ইউরোপীয় ইউনিয়নও মানবাধিকার বলে মনে করে?

আদিলুর রহমানের শাস্তি হওয়ার পর একটি দূতাবাস থেকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে, উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরির ইন্দনকে মানবাধিকার হিসেবে আখ্যায়িত করে। দূতাবাসের বিবৃতিতে জানানো হয়, ‘দূতাবাস মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান এবং পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে আজকের রায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। ... দূতাবাস মনে করে, এটি মানবাধিকারকর্মী এবং সুশীল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালনের সদিচ্ছাকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘যে-ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, অধিকার কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিবেদন তৈরি করেছে। গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ হিসেবে আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজকে অব্যাহতভাবে সমর্থন করি এবং মৌলিক অধিকার নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করি।’

তাদের বক্তব্যও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতোই। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উসকে দেওয়ার জন্য গুজব ছড়ানোর বিষয়টিকে তারা কোন যুক্তিতে মানবাধিকারের আওতাভুক্ত করে? দেশের স্থিতিশীলতা মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখার প্রয়োজনে এধরনের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে থাকার কথা যে কোনো সভ্য দেশ ও মানুষের। তারা ঠিক উল্টোটা করেছে। জীবিত মানুষকে মৃত বানিয়ে যে উত্তেজনা তৈরির প্রয়াস নিয়েছে অধিকার, তাকেও তারা যখন মানবাধিকারের আওতাভুক্ত করে তখন অবাক হওয়া ছাড়া আর কী করার আছে।

আদালত গুজবসৃষ্টিকারীর শাস্তি বিধান করেছে। তার পরের বিষয়টি ভবিতব্য। কিন্তু ‘অধিকার ’ নামের এই এনজিও গুজব সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পরও তারা কীভাবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের পক্ষে মত সৃষ্টির প্রয়াস পেলো। গুজব ছড়ানোই শুধু নয়, এই গুজবের পক্ষে আন্তর্জাতিক মত তৈরির সফলতাও কম বিষয় নয়। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা কি এটা প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে?

কিংবা অধিকারের এ প্রচারণা যে দাঙ্গা বাধানোর প্রয়াস, এ বিষয়টি কি আন্তর্জাতিক মহলে আগাম জানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে? কি করেছে সেটা বিশ্লেষণ ছাড়াই বলা যায়, গুজব ছড়িয়ে কিছু করতে না পারলেও তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের অবস্থানকে শক্ত করার কাজে সফল হয়েছে। তার জন্য যে সরকারি সতর্কতামূলক ব্যবস্থাগ্রহণ যথার্থ ছিল না এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

পশ্চিমারা মানবাধিকার মানবাধিকার বলে চিৎকার করে, আর তাদের টার্গেটেড দেশ ও জাতির ওপরই এটা চাপিয়ে দেয়। কিন্তু নিজেদের মধ্যেই এমন দেশও আছে যেখানে বছরের পর বছর বর্ণবাদের কারণে মানুষ খুন হয়, বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করা হয় প্রকাশ্যে। স্কুলে ঢুকে কচিপ্রাণ সংহার করা হয় ব্রাশ ফায়ারে। সেখানে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে দেখে না।

তাদের দোচোখা নীতির বিষয়টিও আজকে স্পষ্ট। সুতরাং তারা যা বলবে তাই বেদবাক্য হবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ নিজের পথে এগিয়ে যাক, নীতির পথেই চলতে থাক। ভুয়াদের সাচ্চা বানানোর চেষ্টা সবসময়ই অন্ধকারে তলিয়ে যাবে।

লেখক: মোস্তফা হোসেইন গবেষক, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

Share This Article