পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেনাকাটায় অনিয়ম

‘স্বামী-স্ত্রীর প্রকল্পে’ যোগ্য হয়েছে অযোগ্য ঠিকাদার

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:১৮, শনিবার, ৯ মার্চ, ২০২৪, ২৪ ফাল্গুন ১৪৩০

পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পের কেনাকাটায় বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ৯টি দরপত্রে প্রায় শতকোটি টাকার জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম কেনার উদ্যোগ নেয় সরকার। এসব কেনাকাটায় সর্বনিম্ন দরদাতা না হয়েও ৬৪ কোটি টাকার বেশি ৫টি কাজ পেয়েছে বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস। বাকি চারটি কাজও এই প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

একাধিক দরদাতা জানান, বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দিতে সব অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. দিলরুবা ইয়াসমিন লিজা। সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানকে পাঁচটি দরপত্রের প্রায় ৬৪ কোটি ৩৫ লাখ ৮০ হাজার টাকার কাজ পাইয়ে দিয়েছেন। আরও চারটি দরপত্রের কাজ পাইয়ে দিতে সব আয়োজন শেষ করেছেন।

প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) স্বামী ও একই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মশিউর রহমান যন্ত্রপাতি ক্রয়ে কারিগরি কমিটি বা মূল্যায়ন কমিটিতে না থেকেও পছন্দের কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিতে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন। স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও এই কাজে আরও জড়িত ছিলেন ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের সহকারী প্রকৌশলী মাইনুর শুভ, কারিগরি কমিটিতে সদস্য সচিব রেডিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সুমন কুমার বালা, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য গাইনি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট মোসা. ফেরদৌসী আক্তার, টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন কমিটির সভাপতি সিনিয়র কনসালট্যান্ট (সার্জারি) ডা. মনিরুল ইসলাম।

দরপত্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পটুয়াখালী সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পের আওতায় নয়টি দরপত্রে ৯৬ কোটি ৪০ লাখ ১ হাজার টাকার যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নেয় সরকার। সেই লক্ষ্যে গত ২৪ ডিসেম্বর দরপত্র আহ্বান করা হয়।

এর মধ্যে ১৭ কোটি ৪০ লাখ টাকায় একটি সিটি স্ক্যান মেশিন, দুইটি ফোর ডি আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন সঙ্গে ভিডিও প্রিন্টার এবং আরও দুটি সাধারণ আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। অন্য লটে ৬ কোটি ১৩ লাখ ৯৮ হাজার টাকায় ফিজিওলজি বিভিাগ, বায়োক্যামিস্ট্রি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের আওতায় ৮৫ ধরনের ২ হাজার ২৫২টি যন্ত্রপাতি ও রি-এজেন্ট, ৫ কোটি ৪১ লাখ ২৯ হাজার টাকায় প্যাথলজি ও ইমুনলজি বিভাগে ৬৪ ধরনের ২ হাজার ২০টি যন্ত্রপাতি ও রি-এজেন্ট, ৬ কোটি ৪৪ লাখ ৭৪ হাজার টাকায় মাইক্রো বায়োলজি ও ভাইরোলজি বিভাগে ১২৩ ধরনের ১ হাজার ৭০৭টি যন্ত্রপাতি ও রি-এজেন্ট, ১২ কোটি ৯১ লাখ ২ হাজার টাকায় ব্লাড ব্যাংক ও ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগে ৫০ ধরনের ৬৯০টি যন্ত্রপাতি ও রি-এজেন্ট, ৯ কোটি ১৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকায় অপারেশন থিয়েটার ও হেমাটোলজি বিভাগে ২৮ ধরনের ২৫৪টি সরঞ্জাম, ১৯ কোটি টাকায় একটি এমআরআই মেশিন, ৯ কোটি ৮৯ লাখ ৬০ হাজার টাকায় অ্যানেস্থেসিওলজি ও আইসিইউ এবং স্টেলাইজার রুম স্থাপনে ১১ ধরনের ১০৮টি সরঞ্জাম এবং ১০ কোটি টাকা এক্স-রে বিভাগে ৫ ধরনের ৭টি সরঞ্জাম কেনাকাটার উদ্যোগ নেওয়া হয়।


৯টি দরপত্রে বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস, বগুড়া ট্রেড সেন্টার, জেনেসিস ট্রেডিং, এইচটিএমএস লিমিটেড, মাইক্রো ট্রেডার্স, আনিফকো হেলথ কেয়ার, নিউ ভিশন মেডিসিস্টেম, ওশান এন্টারপ্রাইজ, ট্রেড ভিশন, আরপি এন্টারপ্রাইজ, ইনোভেশন টেকনোলজিস্ট ও মেডিলিঙ্ক টেকনো হাটসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।

কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রকল্পের ৯২৭৬১০ আইডির ব্লাড ব্যাংক ও ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের দরপত্রে মাইক্রো ট্রেডার্স, জেনেসিস ট্রেডিং, বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস, এইচটিএমএস ও বগুড়া ট্রেড সেন্টার অংশ নেয়। সেখানে সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল মাইক্রো ট্রেডার্স। তারা দর দিয়েছিল ৯ কোটি ৯৫ লাখ ৭০ হাজার ২৪৯ টাকা। তার চেয়ে ২ কোটি ৪ লাখ ২ হাজার ৭৫০ টাকা বেশি দর দিয়ে ১১ কোটি ৯৯ লাখ ৭৩ হাজার টাকায় তৃতীয় দরদাতা হয়েও দরপত্রটি পেয়েছে বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস। ৯২৭৬১২ আইডির অ্যানেস্থেসিওলজি এবং আইসিইউ বিভাগের দরপত্রে নিউভিশন মেডিসিস্টেম, এইচটিএমএস, আনিফকো হেলথ কেয়ার, বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস ও বগুড়া ট্রেড সেন্টার অংশ নেয়। সেখানে সর্বনিম্ন দরদাতা ছিলেন নিউ ভিশন মেডিসিস্টেম।

তারা দর দিয়েছিল ৬ কোটি ২৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা। তার চেয়ে ২ কোটি ৬৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা বেশি দর দিয়ে ৮ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার টাকায় চতুর্থ দরদাতা হয়েও দরপত্রটি পেয়েছে বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস। এ ছাড়া ৯২৭৬১৩ আইডির এক্স-রে মেশিন কেনাকাটার দরপত্রে এইচটিএমএস, বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস, বগুড়া ট্রেড সেন্টার ও ট্রেড ভিশন অংশ নেয়। সেখানে সর্বনিম্ন দরদাতা ৭ কোটি ৮৮ লাখ ৯৫ হাজার ৯১২ কোটি টাকা দর দিয়েছিল এইচটিএমএস। তার চেয়ে ১ কোটি ২৯ লাখ ৪ হাজার ৮৮ টাকা বেশি দর দিয়ে দ্বিতীয় দরদাতা হিসেবে ৯ কোটি ১৮ লাখ টাকায় কাজটি পেয়েছে বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস।

৯২৭৬১৫ আইডির ১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকায় এমআরআই মেশিন ও ৯২৭৬১৪ আইডির ১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকায় সিটি স্ক্যান মেশিন কেনাকাটার কাজের সর্বনিম্ন দরদাতা না হয়েও প্রকল্প পরিচালকের যোগসাজশে ৬৪ কোটি ৩৫ লাখ ৮০ হাজার টাকার কাজ বাগিয়ে নেয় বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস।

এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা সহযোগী আমিনুল ইসলাম বলেন, উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আমরা কাজ পেয়েছি। দরপত্রের সব শর্ত মেনে যোগ্য হলে পাঁচটি নয়, সব কাজও পেতে পারি–এতে তো কোনো বাধা নেই। এরপরেও অভিযোগ থাকলে মূল্যায়ন কমিটিকে বলেন।

পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি) ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য মোসা. ফেরদৌসী আক্তার বলেন, সরকারি সব নিয়ম বা শর্ত মেনে যারা দরপত্রের আহ্বান করা হয়। যারা সব শর্ত মেনে আবেদন করছে, তারাই কাজ পেয়েছে।

পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও প্রকল্প পরিচালক ডা. দিলরুবা ইয়াসমিন লিজা বলেন, টেন্ডার কমিটির আহ্বানকৃত দরপত্রের শর্তাবলি অনুযায়ী যারা দরপত্র দাখিল করেছেন, শুধু তাদের দরপত্র গৃহীত হয়েছে। আর যারা দরপত্রের শর্তাবলি এবং কর্তৃপক্ষের চাহিদাকৃত মালামালের বর্ণনা অনুযায়ী দরপত্র দাখিল করতে পারেনি তাদের দরপত্র বাতিল করা হয়েছে। এখানে কোনো অনিয়ম কিংবা পক্ষপাতিত্ব করা হয়নি।

বিষয়ঃ বাংলাদেশ

Share This Article