হয়রানির শেষ নেই ঢাকার বাইরের রোগীদের

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:১১, শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ২০ মাঘ ১৪৩০

জাহিদ হাসান 

২০১৫ সালের জুনে স্তন ক্যানসার ধরা পড়ে পাবনার ঝর্না বেগমের (৪০)। তারপর রাজধানীর বেসরকারি ডেল্টা ক্যানসার হাসপাতালে ৮টা কেমোথেরাপি, ২৫টা রেডিওথেরাপি ও সবশেষ মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১২টি কেমোথেরাপি নিয়েছেন। এর বাইরে নিয়মিত ওষুধ খেতে হচ্ছে। নিতে হচ্ছে দামি ইনজেকশন। চিকিৎসার জন্য প্রতিবার ঢাকায় বাসা ভাড়া করে থাকতে হয়েছে।

ক্যানসার আক্রান্তদের পরিস্থিতি জানতে শুক্রবার মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালে গেলে অন্তত ১০ রোগী অভিযোগ করেন, চিকিৎসকরা ভর্তির পরামর্শ দিলেও শয্যা সংকট চরমে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও থেরাপির তারিখ পেতেও সময় লাগছে। তারা বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাইরে বিছানা পেতে অপেক্ষায় রয়েছেন। অনেকে হাসপাতালের আশপাশে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। একইভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল হাসপাতালের অনকোলজি বিভাগে হয়রানির তথ্য পাওয়া গেছে।

ঝর্না বেগমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি জানান, পাঁচ বছর আগে বাম স্তনে চাকার মতো অনুভূত হওয়ায় দ্রুত পাবনার বেসরকারি ইউরো মেডিকেল ক্লিনিকে গেলে কিছু পরীক্ষা টিউমার ধরা পড়ে। চিকিৎসকের পরামর্শে স্থানীয় পপুলার ক্লিনিকে টিউমার অস্ত্রোপচার শেষে বায়োপসি করেন। এবার ব্রেস্ট ক্যানসার শনাক্ত হয়। দেরি না করে রাজশাহীর বেসরকারি ইসলামি ক্লিনিকে যান। চিকিৎসক বাম স্তন কেটে ফেলার পরামর্শ দিলে রাজি হয়ে যান। এরপর রাজধানীর ধানমন্ডির আনোয়ারা মেডিকেল সার্ভিসেস ক্লিনিকে বায়োপসি করে ওই বছরের ১৫ জুলাই ফের ক্যানসার শনাক্ত হয়। এবার দ্রুত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী থেকে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক ৮টা কেমোথেরাপি ও ২৫টা রেডিওথেরাপি দেন। এভাবে টানা পাঁচ বছর ঢাকায় আসা-যাওয়া, থাকা খাওয়া, বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসাবাবাদ খরচ হয়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা। খরচ জোগাতে স্বামীকে চাষাবাদের জমি, হালচাষের গরু বিক্রি ছাড়াও আত্মীয়স্বজনের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা ধার করতে হয়েছে। এরপরও ক্যানসারমুক্ত না হওয়ায় ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ হাসপাতালে সবশেষ ১২টি কেমোথেরাপি নিয়ে ৮ জানুয়ারি বাড়ি যান। ফলোআপ চিকিৎসার জন্য এ মাসের শেষের দিকে চিকিৎসক দেখাতে আসবেন।

এমন বাস্তবতায় অন্যান্য দেশের মতো আজ বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যানাসার দিবস। ২০২২ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বিশ্ব ক্যানসার দিবসের থিম নির্ধারণ করা হয়েছে-ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ অর্থাৎ ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবধান বন্ধ করুন। বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে জানান, দেশে বর্তমানে ১৬ থেকে ১৭ লাখ মানুষ বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারে ভুগছেন। প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ নতুন রোগী যুক্ত হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। একই সময়ের মধ্যে দেশের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য ক্যানসার চিকিৎসায় সুর্নিদিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। রোগটি মোকাবিলায় ২০০৯ সালে নামকাওয়াস্তে একটি কৌশলপত্র তৈরি করা হয়, যা ২০১৪ সালে হালনাগাদ করার কথা ছিল। এরপর ৮ বছর পার হলেও তা হয়নি। অথচ দ্রুত শনাক্তকরণ এবং কার্যকর চিকিৎসায় ক্যানসার নিরাময় সম্ভব। সেবা অব্যবস্থাপনায় প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্ত হচ্ছে না। অধিকাংশ রোগী তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে হাসপাতালে আসছেন। যারা সরকারিতে অপ্রতুল চিকিৎসায় ভুগছেন এবং বেসরকারিতে অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে পারছেন না।

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দীন ফারুক বলেন, পরিস্থিতি বুঝে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হলে সব আগে হাসপাতাল ও জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার রোগী নিবন্ধন জরুরি, যা এখন পর্যন্ত দেশে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা সম্ভব হয়নি। সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি ও গবেষণা ইনস্টিটিউট পাইলট প্রজেক্ট নিয়ে চেষ্টা করছে। এটিও সন্তোষজনক নয়।

তিনি বলেন, দেশে ব্লাড ক্যানসারের বাইরে অন্য ক্যানসারের অস্ত্রোপচারের জন্য সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট আছে। জেলা পর্যায়ে চিকিৎসক রয়েছেন। ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৯০ ভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশে ওষুধ উৎপাদন ও কিছু ওষুধ বাইরে থেকে আনতে হচ্ছে। তবে ক্যানসারের রেডিওথেরাপি চিকিৎসার জন্য ৩০০টি মেশিন দরকার হলেও এ মুহূর্তে দেশে সরকারিভাবে ২২টি এবং বেসরকারিভাবে ১৮টি রেডিওথেরাপি মেশিন আছে। সরকারি মেশিনগুলোর এক দুই-তৃতীয়ংশই বেশিরভাগ সময় অকেজো থাকে। এতে রোগীরা বিপাকে পড়ছেন। এছাড়া মেশিনগুলো পরিচালনার জন্য চিকিৎসকদের পদোন্নতি হচ্ছে না। সব সেন্টারে পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ ও পদোন্নতি দিতে হবে। পাশপাশি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা ব্যয় বৈষম্য দূর করতে হবে।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল হেমাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. কামরুজ্জামান বলেন, একজন মানুষের শরীরে অনেক ধরনের ক্যানসার হতে পারে। যেমন সলিড ক্যানসার (ব্রেইন, লাং, ব্রেস্ট, পাকস্থলী, কোলন, লিভার, কিডনি, জরায়ু, ওভারি, প্রস্টেট ক্যানসার ইত্যাদি)। ব্লাড ক্যানসার (লিউকোমিয়া, লিম্ফোমা, মাল্টিপল মায়েলোমা ইত্যাদি)।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, দেশে ক্যানসার নিয়ন্ত্রণের জন্য সবার আগে কৌশলপত্র তৈরি করে কর্ম পরিকল্পনা নিতে হবে। অনেক আগে জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ পরিষদ করা হয়েছিল। পদাধিকার বলে এ কাউন্সিলের স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা, স্বাস্থ্যমন্ত্রী চেয়ারম্যান এবং ক্যানসার ইনস্টিটিউটের পরিচালক সেক্রেটারি। কাউন্সিলে ক্যানসার প্রতিরোধে নিয়োজিত সংগঠনগুলোকে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু এটি গত ১৫ বছর অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক শনাক্ত, পরীক্ষা-নিরীক্ষা মানুষের দোরগোড়ায় নেওয়া যায়নি। চিকিৎসা এখনো রাজধানীকেন্দ্রিক। বেসরকারিভাবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন ছাড়া সরকারি উদ্যোগ কম। তবে সরকার আট বিভাগে ক্যানসার হাসপাতাল করবে, যা আশা জাগাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী চিকিৎসার জন্য দেশে প্রয়োজন ১৬০টি পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার সেন্টার। এর বিপরীতে ছোটবড় মিলে আছে মাত্র ২৬টি। এ অল্প সংখ্যক চিকিৎসা কেন্দ্রে এত রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসা কেন্দ্র ছাড়াও অভিজ্ঞ জনবল, যন্ত্রপাতি ঘাটতি রয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় ক্যানসার চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অপ্রতুল। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৩০০। আরও ৩ হাজার ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দরকার।

এদিকে দিনটি ঘিরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। রোববার সকাল ১১টায় ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দি রুরাল পুয়র (ডরপ) যুব ফোরামের উদ্যোগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ক্যানসার সচেতনতাবিষয়ক পথনাটিকা অনুষ্ঠিত হবে। দুপুর আড়াইটায় ওয়ার্ল্ড ক্যানসার সোসাইটি বাংলাদেশের উদ্যোগে স্কাউট, গার্ল ইন গাইডস, শিক্ষক, চিকিৎসক নার্স ও বিভিন্ন ক্যানসারবিষয়ক সেবামূলক সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ও দোয়েল চত্বর হয়ে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত ক্যানসার র্যালি, লিফলেট বিতরণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালিত হবে।

বিষয়ঃ বাংলাদেশ

Share This Article