‘বাংলাদেশের জন্য আট বিলিয়ন ডলারের জলবায়ু তহবিল’

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ বিকাল ০৫:০৭, মঙ্গলবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৩, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩০

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন ও মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে একটি তহবিল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ‘বাংলাদেশ জলবায়ু ও উন্নয়ন প্ল্যাটফর্ম’ (বিসিডিপি) নামের এই তহবিল, যার আকার হবে প্রায় ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের যেসব দেশ সবচেয়ে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। দেশটির লাখ লাখ নাগরিক নানা সময়ে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, দাবদাহ ও খরার মতো মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর জীবনপ্রবাহসহ যাবতীয় উন্নয়ন উদ্যোগ তথা দারিদ্র্য দূরীকরণ, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন ও জনস্বাস্থ্য, পল্লি উন্নয়ন ইত্যাদি কর্মযজ্ঞ ব্যাপকভাবে বাধাগস্ত হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি সংকটকে আরও বেশি জোরালো করছে। পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়াও উপকূলের অনেক এলাকার প্রধান সমস্যা হিসেবে প্রতীয়মান। মাত্রাতিরিক্ত গরম জলবায়ু পরিবর্তনের অন্য ধরনের প্রভাব। এতে ফসলি জমি নষ্ট হয়ে মানুষের জীবন-জীবিকা সংকটাপন্ন হচ্ছে। প্রতি পাঁচ বছরে একবার খরার কারণে বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগস্ত হচ্ছে।


সম্প্রতি বিশ্ব তুরস্ক, সিরিয়া এবং আফগানিস্তানে বিশাল ভূমিকম্প, ক্যারিবিয়ান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় হারিকেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় বন্যার মতো সিরিজ বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেছে। বিগত বছর বাংলাদেশ বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়সহ একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে, যার ফলে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। আইপিসিসি রিপোর্ট-২০২২ ভবিষ্যৎ বাণী করেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এবং শেষের দিকে জিডিপির ২ থেকে ৯ শতাংশ ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে।


জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের যে অপরিসীম ক্ষতি হচ্ছে, এটি স্বীকার করে নিয়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশকে এ খাতে ক্ষতি কমাতে দীর্ঘ মেয়াদে সহায়তার লক্ষ্যে বিসিডিপি তহবিল গঠন করে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলনের সাইডলাইনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ প্ল্যাটফরমের কার্যক্রম চালু হয়েছে। এতে আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থায়ন সংস্থা, এশিয়ান অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক, ফ্রান্সের উন্নয়ন সংস্থা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউরোপিয়ান বিনিয়োগ ব্যাংক, দক্ষিণ কোরিয়ার গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড, জাপানি সংস্থা জাইকা ও যুক্তরাজ্যের উন্নয়ন সংস্থা যৌথভাবে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে।

আইএমএফের পাঠানো বিবৃতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি সহায়তা দেবে এডিবি। সংস্থাটির পক্ষ থেকে এখন ৪০ কোটি মার্কিন ডলার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ২০২৩ সালের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ১৯০ কোটি ডলার, যার ৫৩ শতাংশই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ব্যয় করার কথা। এ ছাড়া ২০২৪ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে এডিবি ৫৫০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার অর্ধেক অর্থাৎ ৫০ শতাংশই থাকছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায়।

মোট ৮০০ কোটি ডলারের মধ্যে আইএমএফের অংশ হচ্ছে ১৪০ কোটি ডলার। গত জানুয়ারিতে আইএমএফ যে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে, তার মধ্যেই এটি অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের ১০০ কোটি, এআইআইবির ৪০ কোটি এবং কোরীয় সরকারের ৪ কোটি ডলার থাকছে। অন্য সংস্থাগুলোরও কমবেশি অর্থায়ন থাকছে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম সারিতেই রয়েছে। বাংলাদেশের রয়েছে ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ এবং মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা। অর্থাৎ, বিনিয়োগের অগাধিকার খাত নির্ধারণের ফ্রেমওয়ার্কও বাংলাদেশের রয়েছে। জাতীয় প্রকল্পের সঙ্গে জনগণের সম্পদের মেলবন্ধনের বিষয়টি বাংলাদেশ সরকার চিহ্নিত করেছে। বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, আইএমএফসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা বাংলাদেশের জাতীয় পরিকল্পনায় অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে এসেছে, যা খুবই আশাব্যঞ্জক। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের নেওয়া পরিকল্পনাগুলো ও এসকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের প্রচেষ্টা সব দিক বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এশিয়া মহাদেশে প্রথমবাবরে মতো বাংলাদেশকে ৮০০ কোটি ডলার প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে।

জলবায়ু সহনশীলতা, অভিযোজন, প্রস্তুতি ও সংরক্ষণকে আরও শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ সরকার উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগজনিত ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনকে প্রাধান্য দিয়ে ১০০ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এই ডেল্টা প্ল্যান- ২১০০ বা ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ গ্রহণ করা হয়েছে ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডের আদলে। ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যান হিসেবে ডেল্টা প্ল্যান-২১০০-এর অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। শতবর্ষী এই ডেল্টা প্ল্যানের অভীষ্ট লক্ষ্যগুলো হলো বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষার কৌশল খুঁজে বের করা, নগর ও শহরের নিরাপদ পানি সরবরাহ করা, টেকসই নদী অঞ্চল, জলাভূমি সংরক্ষণ, আন্তঃদেশীয় নদীর পানির সুষম বণ্টন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নতকরণ। এ মহা-পরিকল্পনার জাতীয় পর্যায়ের লক্ষ্যগুলো হলো ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন করা : ২০৩০ সাল নাগাদ চরম দরিদ্রতা দূরীকরণ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ একটি উন্নত সমৃদ্ধিশীল দেশের মর্যাদা লাভ করা। এ পরিকল্পনার অগগতি তদারকি করার জন্য ৫ বছর পর পর ডেল্টা প্ল্যানের তথ্য হাল-নাগাদ করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের পদক্ষেপ শুরু হয় ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিলেন। এই কর্মসূচির আওতায় বঙ্গবন্ধু উপকূলীয় এলাকায় ১ হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছিলেন। জনগণ এই কেন্দ্রগুলোকে ‘মুজিব কেল্লা’ বলে ডাকত। এর আগে ১৯৭০ সালে, একটি প্রলয়ঙ্কারি জলোচ্ছ্বাস প্রতিকূলতা সহিষ্ণু অবকাঠামোর অভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছিল।

বর্তমান সরকার ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং এবং পুনঃখনন করেছে। ১৩৯টি উপকূলীয় পোল্ডারের পাশাপাশি প্রায় ২২,০০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে এই অবকাঠামোগুলো ২০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে বন্যার ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে সুরক্ষা দিচ্ছে। সরকার এখন পর্যন্ত ১ হাজার ২২৯ কিলোমিটার নদী তীর সুরক্ষা বাধ সম্পন্ন করেছে। দুর্যোগ থেকে সুরক্ষার জন্য বর্তমান সরকার ৪ হাজার ৫৩০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে- এর মধ্যে কিছু নিয়মিত স্কুল হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষ ও গবাদিপশুকে আশ্রয় দেয়াসহ একাধিক ব্যবহারের জন্য মাটি উঁচু করে ৫৫০টি মুজিব কিল্লা নির্মাণ করা হয়েছে।

দুর্যোগ মোকাবিলায় বর্তমানে দেশে ৫টি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার, ৯টি ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র এবং ১৪টি নদী বন্দরে নৌ-দুর্ঘটনা প্রশমনের লক্ষ্যে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ ও পূর্বাভাস কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, এ ছাড়া স্থাপন করা হয়েছে ৩টি স্যাটেলাইট গাউন্ড স্টেশন। দুইটি আধুনিক ডপলার রাডার স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। দেশের ১৩টি উপকূলীয় জেলায় স্যাটেলাইট টেলিফোনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুর্যোগের আগাম সতর্কবার্তা ও দৈনন্দিন আবহাওয়া বার্তা জানতে মোবাইলে ‘১০৯০’ নম্বরে টোল ফ্রি সার্ভিস চালু করা হয়েছে। বর্তমান সরকার দেশের কৃষি-আবহাওয়া পূর্বাভাস ও পরামর্শ সেবার মান উন্নয়নে সাতটি নতুন কৃষি- আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার স্থাপনসহ কৃষি- আবহাওয়াবিষয়ক গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করেছে।

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়ঃ বাংলাদেশ

Share This Article


তীব্র গরম থেকে জনগণকে স্বস্তি দিতে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে ডিএনসিসি

মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে ইচ্ছেকৃত ভুল নাকি অপরিপক্কতা?

নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ কিনছে ভারত, অপেক্ষায় বাংলাদেশ

ভুটানকে বিবিআইএনএ-তে চায় বাংলাদেশ

বাংলাদেশিদের জন্য সহজ হচ্ছে ব্রাজিলের ভিসা

স্যাটেলাইট ব্যবহারে সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশ-মরিশাসের আলোচনা

বাংলাদেশের উন্নতি দেখে আমাদের লজ্জা হয়: পাক প্রধানমন্ত্রী

সরকারি সুবিধাভোগী নির্বাচনের প্রচারে নামলে প্রার্থীতা বাতিল: ইসি রাশেদা

থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ নথি সই, চিকিৎসা খাতে বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী

চলতি বছরই থাইল্যান্ডের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আশা প্রধানমন্ত্রীর

আরও ১৪ পণ্য পেল জিআই সনদ

এনডিএমএ গঠন : ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাহসী পদক্ষেপ