অবিনাশী জননী তুমি শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১১:০৭, মঙ্গলবার, ৮ আগস্ট, ২০২৩, ২৪ শ্রাবণ ১৪৩০

মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্‌পু

ধৈর্য, নিষ্ঠা, সহিষ্ণুতা ও বিচক্ষণতা- অকৃত্রিম এই চার গুণের সংমিশ্রণ ছিলেন বাঙালির অবিনাশী জননী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু নিজেও বলেছেন, আমার জীবনে বৃহৎ অবলম্বন দুটি। এক, আমার আত্মবিশ্বাস, দুই, আমার স্ত্রী, আমার আকৈশোর গৃহিণী। বঙ্গবন্ধু যদি বাঙালির বটবৃক্ষ হয়ে থাকেন; তবে বঙ্গমাতা হলেন সেই গাছ, যেটি বটবৃক্ষকে ছায়া দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যদি সম্মুখ সমরের সর্বাধিনায়ক হন, তবে বঙ্গমাতা হলেন সেই নায়কের হাতের মশাল; যেটি অন্ধকার পথে আলো ছড়িয়েছিল। তিনি সাধারণে অসাধারণ, চিরায়তে চিরন্তন। তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা এড়িয়ে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস লেখার সুযোগ নেই।

 

কালের বিবর্তনে ছোট্ট খোকার শেখ মুজিব, মুজিব ভাই কিংবা বঙ্গবন্ধু রূপে আবির্ভাব- জাতির পিতার এই পুরো গল্পে স্বপ্নসারথি হয়ে পাশে ছিলেন বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তিনি যে শুধু অনুপ্রেরণা দিয়েছেন তা নয়; সাহস জুগিয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, সময়ের প্রয়োজনে নিয়েছেন সিদ্ধান্তও। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কাছে তিনি একদিকে যেমন আদর্শ ভাবি ছিলেন; তেমনি ছিলেন বিচক্ষণ উপদেষ্টা, পরামর্শদানকারী ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সবচেয়ে বড় গেরিলা। কারান্তরিনকালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা কীভাবে গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সবার কাছে পৌঁছে দিতে হয়, তার অহরহ নজির স্থাপন করেছেন বেগম মুজিব। আর দশটা নারীর মতো তিনি সাধারণ জীবনে অভ্যস্ত হলেও দেশ ও দশের প্রয়োজনে সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত এসেছে এই জননীর হাত ধরে।

এক্ষেত্রে ছোট্ট একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। সাল ১৯৪৬, তখনো দেশ ভাগ হয়নি। মাত্র ২৬ বছর বয়সের তরুণ রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিবুর রহমান। ওই বছরেই অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কাউন্সিলে ১৬ আগস্টকে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘোষণা করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। এতে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আরও বেড়ে যায়। এমন কঠিন সময়েই বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুকে ডেকে পাঠান। নির্দেশনা দেন। অঞ্চলে অঞ্চলে গিয়ে বোঝাতে হবে, এই সংগ্রাম হিন্দু-মুসলিমদের নয়, বরং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। পুরো পরিস্থিতি শঙ্কায় ঘেরা ছিল, ছিল জীবননাশের ঝুঁকিও। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। যাওয়ার আগে টুঙ্গিপাড়ার গ্রামের বাড়িতে থাকা অসুস্থ স্ত্রীর অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখলেন। জবাবে স্ত্রী রেণু (বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব) চিঠি লিখলেন, “আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিত মনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লার ওপর আমার ভার ছেড়ে দেন।” এ চিঠির মর্মার্থ জানার পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন,  Mujib, she is a very precious gift to you from God. DonÕt neglect her, please (মুজিব, সে তোমার জন্য স্রষ্টার দেওয়া অতি অমূল্য দান। অনুগ্রহ করে তাঁকে অবহেলা কর না)। এই ছিলেন বাংলাদেশের অন্তঃপ্রাণ বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা, এই ছিলেন জাতির পিতার রেণু।
৫৪ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এক-চতুর্থাংশ সময়ই কারাগারে কাটাতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। দিন ও বছর হিসেবে এটি ৪ হাজার ৬৮২ দিন, এক যুগেরও বেশি সময়। কারাজীবনের দীর্ঘ এ সময়ের বাঁকে বাঁকে দেশ ও দলের প্রয়োজনে দক্ষ মাঝির মতো হাল ধরেছিলেন বেগম মুজিব, ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গী হয়ে। নিজে ত্যাগ স্বীকার করেছেন কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে কখনো তাঁর কাজ হতে, দেশের সেবা হতে বিরত রাখেননি। বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন তাঁর ও তাঁর পরিবারের জন্য সবচেয়ে বেশি বেদনাদায়ক হলেও সেটাও মেনে নিয়েছেন অকৃত্রিম হাসি দিয়ে। একবার জেলে বঙ্গবন্ধু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে শেখ ফজিলাতুন নেছার অশ্রুভরা আকুতি আমরা জানতে পারি বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। জাতির পিতা লিখেছেন, “রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, জেলে থাকো আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখো। তোমাকে দেখে আমার মন খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন।” স্বামীর প্রতি বুকভরা ভালোবাসা থাকলেও তাঁর রাজনীতি এমনকি জেলজীবন নিয়ে কখনো প্রশ্ন তোলেননি বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণা- ‘আমার জীবনেও আমি দেখেছি, গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনো দিন আমার স্ত্রী বাধা দেয় নাই। এমনও দেখেছি, অনেকবার আমার জীবনের ১০/১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনো দিন মুখ কালা কিংবা আমার ওপর প্রতিবাদ করেনি। তাহলে বোধহয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। অনেক সময় আমি দেখেছি, আমি যখন জেলে চলে গেছি আমি একআনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে।’

বঙ্গবন্ধুর এই উক্তির মর্মার্থ অনুধাবন করলে সহজেই বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন বঙ্গমাতা! একদিকে সন্তান-সংসার সামলানো; অন্যদিকে কারাগার থেকে দল ও দেশের জন্য পরামর্শ নিয়ে আসা, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক, আইনজীবীদের কাছ থেকে মামলার খোঁজখবর, স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে মামলার খরচ চালানো, নেতা-কর্মীদের সংকটে পাশে দাঁড়ানো- এসবই তাঁর রুটিন ওয়ার্ক। ‘স্মৃতি বড় মধুর, স্মৃতি বড় বেদনার’ প্রবন্ধে কন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন- “আন্দোলনের সময় বা আব্বা বন্দি থাকা অবস্থায় পার্টির কাজকর্মে বা আন্দোলনে খরচের টাকাও মা জোগাতেন। অনেক সময় বাজার হাট বন্ধ করে অথবা নিজের গায়ের গহনা বিক্রি করেও মাকে দেখেছি সংগঠনের জন্য অর্থের জোগান দিতে।” স্বাধীনতার ৫১ বছরে এসে আজ বলতেই হবে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রকৃত মূল্যায়ন যেমন হয়েছে, তেমনি মূল্যায়িত হয়েছেন তাঁর পত্নী বেগম ফজিলাতুন নেছাও। আমাদের প্রাপ্তি এটাই।

॥ দুই ॥

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া পরবর্তী সময়েও দৃঢ়চিত্তে সবকিছু সামলেছেন মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। কেমন ছিল সে সময়ের তাঁদের পরিবার ও দাম্পত্য জীবন? ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- “বাসায় এসে দেখলাম, রেণু এখনো ভালো করে সংসার পাততে পারে নাই। তাকে বললাম, ‘আর বোধহয় দরকার হবে না। কারণ মন্ত্রিত্ব ভেঙে দেবে, আর আমাকেও গ্রেফতার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা, বোধহয় বাড়িই চলে যেতে হবে। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলা, ঢাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ হবে, তা বোধহয় হলো না। নিজের হাতের টাকা-পয়সাগুলিও খরচ করে ফেলেছ।’ রেণু ভাবতে লাগল, আমি গোসল করে ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম করছিলাম। বেলা তিনটায় টেলিফোন এলো, কেন্দ্রীয় সরকার ৯২(ক) ধারা জারি করেছে। মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করা হয়েছে।”

’৫৪-এর নির্বাচনে জয়লাভের পরও বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। এ দফায় ২০৬ দিন কারাভোগ করেন তিনি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারির পর আরেক দফায় গ্রেফতার হন ১১ অক্টোবর। এ সময় একটানা ১ হাজার ১৫৩ দিন কারাগারে আটকে রাখা হয় তাঁকে। মূলত এ সময়েই গৃহবধূ থেকে আন্দোলন-সংগ্রামের পুরোধায় পরিণত হন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। মুক্তির সনদ ৬ দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করতে গেলে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন পাকিস্তান সরকার তাঁকে আবারও গ্রেফতার করে। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে ধর্মঘট সফল করতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেন বেগম মুজিব। গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি এড়িয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতেন। এমনও হয়েছে, কোনো কোনো দিন ছেলেমেয়েদের আত্মীয়র বাসায় রেখে সেখানেই পায়ের স্যান্ডেল, কাপড় বদলে বোরকা পরতেন; এরপর দূরে গিয়ে নেতা-কর্মীর সঙ্গে বৈঠক করে আন্দোলনের নানা দিক নিয়ে পরামর্শ ও নির্দেশনা দিতেন।

১৯৬৬ সালের ১৯ মে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ছিল দলের ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা। অনুষ্ঠান আয়োজনে তেমন সুযোগ-সুবিধা না থাকায় নিজ হাতে সবাইকে রান্না করে খাইয়েছেন বেগম মুজিব। এরপর বঙ্গবন্ধুর দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী নির্দেশনা দেন- আর যাই হোক, ৬ দফা থেকে একচুলও নড়া যাবে না। রাজনৈতিক জাতীয় সংকট উত্তরণে বঙ্গমাতার সেই সময়ের মানসিক দৃঢ়তা অনেক সমস্যার সমাধান এনে দিয়েছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর মনোবল ছিল সবচেয়ে কার্যকর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায়, “মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস আম্মার যে মনোবল দেখেছি, তা ছিল কল্পনাতীত। স্বামীকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে গেছে। দুই ছেলে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। তিন সন্তানসহ তিনি গৃহবন্দি। যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন; কিন্তু আম্মা মনোবল হারাননি।”

১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলা চলাকালেও রাজনীতি থেকে দূরে থাকা মুজিব গিন্নি ছিলেন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। রাজনীতির অলক্ষ্যে থেকেও তিনি রেখেছিলেন আশাজাগানিয়া অবদান। ‘মুজিব ভাই’ গ্রন্থের ‘প্রেরণাদায়িনী ফজিলাতুন নেছা মুজিব’ অধ্যায়ে এ বি এম মূসা লিখেছেন, “চলছে জল্পনা-কল্পনা। শেখ সাহেব কি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইয়ুবের বৈঠকে যাবেন? ক্যান্টনমেন্টে বসে শেখ সাহেব কী ভাবছেন, কেউ তা জানে না। সারা দেশের মানুষও কিছুটা বিভ্রান্ত। তারা প্রাণ দিচ্ছে, রক্ত দিচ্ছে প্রিয় নেতাকে মুক্ত করে আনার জন্য, মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যাওয়ার জন্য নয়। ...সেদিন মুচলেকা দিয়ে নাকি নিঃশর্ত মুক্তি- এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং জানিয়েছিলেন একজন নারী। মুজিবের সহধর্মিণী, যিনি রাজনীতি বুঝতেন না; কিন্তু নিজের স্বামীকে জানতেন। বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর স্বামীর মানসিক দ্বন্দ্ব। বন্দি স্বামীকে চিরকুট পাঠালেন, “হাতে বঁটি নিয়ে বসে আছি প্যারোলে মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যেতে পারেন; কিন্তু জীবনে ৩২ নম্বরে আসবেন না।’’ এ বি এম মূসার ভাষ্য, এখন ভাবতে অবাক লাগে, আধা শিক্ষিত সাধারণ যে গৃহবধূ রাজনীতি বোঝেন না, অথচ সেই তিনি রণচ-ী মূর্তি ধারণ করে কী অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন! কতখানি রাজনৈতিক দূরদর্শিতা নিয়ে দূর থেকে শক্তি, সাহস আর বুদ্ধি জোগালেন স্বামীকে।

বঙ্গবন্ধুর প্রেরণাদায়িনী এভাবেই দিনকে দিন রেণু থেকে বেগম মুজিব, বেগম মুজিব থেকে বঙ্গমাতা হয়ে ভরসার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিলেন সবার কাছে। সেদিন যদি তিনি এই সাহসী ভূমিকা পালন না করতেন, তবে আজ হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্নভাবে রচিত হতে পারত। শুধু আগরতলা মামলাকালীন সময়ই নয়, বাংলার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণকারী এমন অগণিত সিদ্ধান্তের পেছনে ভূমিকা রেখেছিলেন মহীয়সী এই গৃহিণী।

আগরতলার মামলার রেশ ধরেই আসে প্রবল গণআন্দোলন তথা উত্তাল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান; আদতে যা মহান মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ। ছাত্ররা বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। সবাই তাকিয়ে আছে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে। তারা প্রিয় নেতার মুখ থেকে স্বাধীনতার ডাক শুনতে চায়। সে সময় একদিকে আমেরিকা ও পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র চলছে, অন্যদিকে অপারেশন ব্লিৎসের মতলবে ব্যস্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। পরিস্থিতি এমন যে, বাঙালির ভাগ্য তখন রেসকোর্স ময়দানের নির্দেশনার ওপর নির্ভর করছে। প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুও তখন চিন্তাগ্রস্ত। এমন সময়ে ত্রাণকর্ত্রী হয়ে আবারও আবির্ভূত হলেন বেগম মুজিব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায়- “আমি মাথার কাছে বসা, মা মোড়াটা টেনে নিয়ে আব্বার পায়ের কাছে বসলেন। মা বললেন, মনে রেখো তোমার সামনে লক্ষ মানুষের বাঁশের লাঠি। এই মানুষগুলির নিরাপত্তা এবং তারা যেন হতাশ হয়ে ফিরে না যায় সেটা দেখা তোমার কাজ। কাজেই তোমার মনে যা আসবে তাই তুমি বলবা, আর কারও কোনো পরামর্শ দরকার নাই। তুমি মানুষের জন্য সারাজীবন কাজ করেছ। কাজেই কী বলতে হবে তুমি জানো।” এর পরের ইতিহাস আমাদের কারও অগোচরে নেই। রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের সম্মুখে রাজনীতির এই অমর কবি পাঠ করলেন তাঁর সেই মহাকাব্যিক শ্লোক- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

তখন স্বাধীনতার অন্তিম মুহূর্ত চলছে। রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণে ব্যস্ত। দেশবাসীও বিজয়ের আনন্দে ভাসছে। এখানে বলে রাখি, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ঘোষিত হলেও বেগম মুজিব ও তাঁর পরিবারের সদস্য ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্দি ছিলেন। অবশেষে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর মেজর তারার হস্তক্ষেপে বাড়ির পাহারায় নিয়োজিত পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যরা ১৭ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। এরপর বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসেন বেগম মুজিব। স্মৃতির দখিন দুয়ারে লেখা হয়েছে- ‘দরজা উন্মুক্ত। আমরা সব ঘর থেকে ছুটে বারান্দায় চলে এলাম, ওরা সব অস্ত্র ফেলে দিয়ে একে একে সারেন্ডার করে গেল। মা সঙ্গে সঙ্গে আবদুলকে হুকুম দিলেন পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ফেলতে। পতাকাটি নামিয়ে মা’র হাতে দিতেই মা ওটাকে নিচে ফেলে পা দিয়ে মাড়াতে শুরু করলেন। তারপর ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে আগুন ধরিয়ে দিলেন। দুই পাশ থেকে জনতার ঢল নামল। সাংবাদিকরা ছুটে এলেন। মুক্ত হবার আনন্দের কান্নায় আমরা সবাই ভেঙে পড়লাম।’ এই ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বেগম মুজিবের তেজদীপ্ত রূপ।

॥ তিন ॥

স্বাধীনতা-সংগ্রাম-প্রেরণার বাইরেও বঙ্গবন্ধুর আজন্ম ছায়াসঙ্গী ছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। শৈশব-কৈশোর তো বটেই, দাম্পত্য জীবনেও সম্মান ও ভালোবাসায় দুজন দুজনের পরিপূরক ছিলেন। তাই হয়তো শুধু জীবন নয়, মৃত্যুকেও তাঁরা বরণ করে নিয়েছেন একই সঙ্গে। সে হিসেবে জীবনের শেষ দিন নয়, বরং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁরা পরস্পর পরস্পরের পাশে ছিলেন। কন্যার স্মৃতিচারণা, ‘ঘাতকরা যখন আমার বাবাকে হত্যা করল তিনি তো বাঁচার আকুতি করেননি। তিনি বলেছেন, ওনাকে যখন মেরে ফেলেছ আমাকেও মেরে ফেল, এভাবে নিজের জীবনটা উনি দিয়ে গেছেন।’

বঙ্গবন্ধুর কতটা জায়গাজুড়ে ছিলেন শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তার অসংখ্য-অগণিত প্রমাণ পাওয়া যায় শেখ হাসিনা-শেখ রেহানা এমনকি বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখায়। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই রাজনীতিবিদের লেখক হয়ে ওঠার গল্পেও রয়েছে শেখ ফজিলাতুন নেছার অকৃত্রিম অবদান। আজ যে অসমাপ্ত আত্মজীবনী আড়ালে বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে পারছি, তার নেপথ্যেও রয়েছে বেগম সাহেবার ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী’ শীর্ষক অনুপ্রেরণামূলক সরল উক্তি। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘‘...রেণু আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।” সহজেই অনুমেয়, সহধর্মিণী বঙ্গমাতা যদি বঙ্গবন্ধুকে তাগাদা না দিতেন, তাহলে কি মহামূল্যবান ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি রচিত হতো? জানতে পারতাম বঙ্গবন্ধুর জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা বাংলার শত শত না বলা গল্প? নিশ্চয়ই না।

শেষ করব, তার আগে ১৯৯৭-এর ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া ভাষণ উদ্ধৃত করতে চাই। কাজী নজরুলের কবিতা পড়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা সেদিন বলেছিলেন, ‘জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান/মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।’ বক্তব্যে সেইসব মাতা ভগ্নী ও বধূদের উদাহরণে অন্য সব নামের সঙ্গে তিনি যে নামটি উল্লেখ করেছিলেন সেটি হলো- মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও সংগ্রাম-স্বাধীনতায় কোটি বাঙালির সারথি হয়ে ওঠা এই বিজয়লক্ষ্মী নারীর অবদান জাতি কোনো দিন ভুলবে না। তিনি বঙ্গবন্ধুর শক্তি, তিনিই বাংলাদেশের আলোকবর্তিকা।          

লেখক : রাষ্ট্রপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ

Share This Article


চট্টগ্রামে ৪৮ ঘণ্টা পরিবহন ধর্মঘটের ডাক

রাজধানীর ১০ থানায় কিশোর গ্যাং বেশি: ডিএমপি কমিশনার

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবার সাপ্তাহিক ‘ছুটিই থাকছে’

বনানীতে যাত্রীবাহী বাসে আগুন

৯ মে থেকে হজের প্রথম ফ্লাইট শুরু: ধর্মমন্ত্রী

তীব্র গরম থেকে জনগণকে স্বস্তি দিতে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে ডিএনসিসি

মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে ইচ্ছেকৃত ভুল নাকি অপরিপক্কতা?

নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ কিনছে ভারত, অপেক্ষায় বাংলাদেশ

ভুটানকে বিবিআইএনএ-তে চায় বাংলাদেশ

বাংলাদেশিদের জন্য সহজ হচ্ছে ব্রাজিলের ভিসা

স্যাটেলাইট ব্যবহারে সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশ-মরিশাসের আলোচনা

বাংলাদেশের উন্নতি দেখে আমাদের লজ্জা হয়: পাক প্রধানমন্ত্রী