হিট অ্যালার্ট
বৃষ্টির জন্য বিভিন্ন স্থানে নামাজ আদায়
তাপমাত্রা সামান্য কমলেও আজ মঙ্গলবার থেকে তা আবার বাড়তে পারে। আসলে চলতি এপ্রিল মাসের বাকি সময়টা তাপপ্রবাহ থেকে নিস্তার নেই। এই সময় বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্য থাকবে। ফলে গরমের অস্বস্তি বাড়বে।
ক্রমশ খেয়ালী হয়ে উঠছে আবহাওয়া। নিয়মের অনুশাসন মানছে না ঋতুচক্র। অস্বাভাবিক রুক্ষ-রুদ্র-রুষ্ঠ-তাতানো আচরণ করছে তাপমাত্রা। দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে তাপদাহ। অতীতে এপ্রিল মাসে দেশে এত দীর্ঘ সময় টানা চরম উষ্ণতার বিস্তার দেখা যায়নি। দেশের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেলেও তপ্ততা অসহনীয় মাত্রায় আছে। গতকাল তিন জেলা খুলনা,যশোর এবং চূয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা না থাকায় সারা দেশে বুধবার পর্যন্ত ‘হিট অ্যালার্ট’ বা তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। চলতি মাসে এ নিয়ে টানা তৃতীয় দফায় ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করা হলো। গতকালও হিট স্ট্রোকে ঢাকাসহ ৭ জেলায় ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আল্লাহর কাছে বৃষ্টির প্রার্থনায় কুস্টিয়ার কুমারখালী, রাজবাড়ির বালিয়াকান্দিসহ বিভিন্ন স্থানে ইসতিস্কার নামাজ আদায় করেছে মানুষ।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, গতকাল সোমবার তাপমাত্রা সামান্য কমলেও আজ মঙ্গলবার থেকে তা আবার বাড়তে পারে। আসলে চলতি এপ্রিল মাসের বাকি সময়টা তাপপ্রবাহ থেকে নিস্তার নেই। এই সময় বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্য থাকবে। ফলে গরমের অস্বস্তি বাড়বে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঢাকাসহ বাংলাদেশের ৪৫টির বেশি জেলার ওপর দিয়ে এখন তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। একইসাথে দিনের গড় তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গেছে। কার্যত সিলেট বিভাগ বাদে সারাদেশেই জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বাংলাদেশের কিছু জেলায় তাপপ্রবাহ বইতে শুরু করে। এরপর গত দুই সপ্তাহে তাপপ্রবাহ প্রায় সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই যশোরে চলতি বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। আর ঢাকায় এ বছর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই এপ্রিল মাসে গড়ে সাধারণত ২-৩টি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ এবং এক থেকে দু’টি তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। কিন্তু এবছর সেই নিয়মের মধ্যে নেই। তীব্র তাপপ্রবাহ অনুভূত হওয়ায় ইতোমধ্যেই তিনটি হিট অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহেও নতুন হিট এলার্ট জারি করা হতে পারে বলে ধারণা করছেন আবহাওয়াবিদরা।
আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানান,বাংলাদেশে সাধারণত কোনও স্থানের তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে সেখানে সতর্কবার্তা জারি করা হয়। বিগত বছরের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে চলতি ২০২৪ সাল উত্তপ্ত বছর হিসেবে যাবে। আমরা এ বছর তাপপ্রবাহের দিন এবং হার বেশি পেতে যাচ্ছি। এর কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। বাংলাদেশের তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতিতে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ছোঁয়া লেগেছে।এছাড়া বনভূমির পরিমাণ কমে যাওয়া, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং শিল্পায়ন ও নগরায়ন বেড়ে যাওয়ার কারণেও সার্বিকভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে।
আবহাওয়াবিদ শাহ আলম বলেছেন, সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা দুই থেকে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে গড়ে তাপমাত্রা থাকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এ বছর সেটি বৃদ্ধি পেয়ে গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে সারা দেশেই তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। তিনি বলেন, সামনে গড় তাপমাত্রা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকলে এটি বাংলাদেশের উষ্ণতম বছরও হতে পারে। এর আগে, ২০২৩ সালকে বাংলাদেশের উষ্ণতম বছর হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন আবহাওয়াবিদরা।
শাহ আলম বলেন, মৌসুমী বায়ু আসতে দেরি হওয়ায় এবছরের তাপপ্রবাহের স্থায়িত্ব বাড়তে পারে। এমনকি তাপপ্রবাহের ব্যাপ্তিকাল আগের বছরগুলোকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ বছর মৌসুমী বায়ুর জন্য জুন মাস পর্যন্তও অপেক্ষা করা লাগতে পারে।
আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন,পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে বাংলাদেশে এবছর এপ্রিলে গড় তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কম হচ্ছে। ফলে গরম থেকেই যাচ্ছে। ভারি বৃষ্টিপাত হলেই গরম কেটে যাবে। কিন্তু কাছাকাছি সময়ে সেই বড় ধরনের বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি হচ্ছে তাতে গরম কমবে না।
এদিকে হিট অ্যালার্ট থেকে পরিত্রাণ পেতে চিকিৎসকদের পরামর্শ প্রচুর পানি পান করতে হবে। যতটা সম্ভব বাইরে বের হওয়া যাবে না। গাছ কিংবা শেডের নিচে থাকার চেষ্টা করতে হবে। খোলা আকাশের নিচে থাকলে হ্যাট ও ঢিলেঢালা সুতি কাপড় পরতে হবে। প্রস্র্রাবের রঙ হলুদ হলে আরও বেশি পানি পান করতে হবে। সম্ভব হলে পানি দিয়ে বারবার শরীর মুছতে হবে। প্রয়োজনে কাজের সময় পরিবর্তন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পরিশ্রমের কাজ বিকেলে করাই ভালো বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইসিডিডিআরবির পরামর্শক ডা. মো. ইকবাল হোসেন বলেন, হিট স্ট্রোকের লক্ষণগুলোর মধ্যে অনেক ঘাম হবে, পানিশূন্যতাও হবে, প্রচণ্ড দুর্বলতা থাকবে, আর জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। সবচেয়ে পিক হিট থাকে দুপুর ১২টা থেকে ৩টা। কায়িক পরিশ্রমের কাজগুলো সন্ধ্যা বা রাতে করার চেষ্টা করলে তুলনামূলক ভালো।
রাজধানীতে রিকশাচালকের মৃত্যু: ঢাকা মেডিকেল নার্সিং কলেজের পেছনের রাস্তায় আবদুল আউয়াল (৪৫) নামে এক রিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে হিট স্ট্রোকে। গতকাল সোমবার বিকেল সোয়া ৪টার দিকে ওই রিকশাচালককে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হাসপাতালে শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সুমন বসাক বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই রিকশাচালক রিকশা চালিয়ে এসে নার্সিং কলেজের পেছনের রাস্তায় কাঁপতে কাঁপতে পরে গিয়ে অচেতন হয়ে যান। ধারণা করা হচ্ছে হিট স্ট্রোকে তার মৃত্যু হয়েছে। মৃত আবদুল আউয়ালের রিকশার মালিক মহিবুল আলম বলেন, আউয়ালের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানার সিংহগ্রামে। বাবার নাম আজম আলী। তিনি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার শিবু মার্কেট এলাকায় থাকতেন এবং আমার গ্যারেজের রিকশা চালাতেন।
আলমডাঙ্গায় দুই নারীর মৃত্যু: আলমডাঙ্গা (চুয়াডাঙ্গা) সংবাদদাতা জানান,চুয়াডাঙ্গায় অতি তীব্র তাপপ্রবাহে এক ঘণ্টার ব্যবধানে ২ জন নারী মারা গেছেন। তারা দু’জনই আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদাহ ইউনিয়নের বেগুয়ারখাল গ্রামের বাসিন্দা। গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ৯টায় স্বামীর জন্য মাঠে ভাত নিয়ে যাওয়ার সময় আশুরা খাতুন (২৫) প্রাণ হারান। এছাড়া সকাল সাড়ে ১০টায় আয়েশা বেগম (৭০) নামের আরও একজন মারা যান।
কালকিনিতে কৃষকের মৃত্যু: কালকিনি (মাদারীপুর) সংবাদদাতা জানান, মাদারীপুরের ডাসারে তীব্র গরমের মধ্যে জমিতে কাজ করতে গিয়ে আজগর আলী বেপারী (৭৫) নামে এক বৃদ্ধ কৃষকের হিট স্ট্রোকে মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সোমবার পুলিশ সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। নিহত আজগর আলী উপজেলার গোপালপুর এলাকার পশ্চিম বনগ্রাম গ্রামের বরম আলীর ছেলে।
বাগেরহাটে গাছির মৃত্যু:বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, জেলার ফকিরহাটে প্রচন্ড দাবদাহে হিট স্ট্রোকে এক গাছির মৃত্যু হয়েছে। সকাল ১০টার দিকে গাছ কাটতে উঠে হিট স্ট্রোকে তিনি গাছ থেকে পড়ে মারা যান। ওই গাছির নাম আমজাদ হোসেন শেখ (৫৭)। তিনি সদর উপজেলার ভট্টপ্রতাপ গ্রামের আজহার আলী শেখের ছেলে।
রাজশাহীতে কৃষকের মৃত্যু: রাজশাহী অফিস জানায়, রাজশাহীর বাগমারায় ভুট্টা খেতে কাজের সময় হিট স্ট্রোকে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনার সময় দুপুরে বাগমারার তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। নিহত কৃষকের নাম মন্টু হোসেন (৪৫)। তিনি উপজেলার গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামের মোশলেম আলীর ছেলে।
পাবনায় কৃষকের মৃত্যু: পাবনা প্রতিনিধি জানান,পাবনার চাটমোহরে মাঠে কাজ করতে গিয়ে হিট স্ট্রোকে আলাউদ্দিন আলী আলাল (৪৩) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার মূলগ্রাম ইউনিয়নের নেউতিগাছা এলাকার মো. ইউসুফ আলীর ছেলে।
পিরোজপুরে সেলুন শ্রমিকের মৃত্যু: পিরোজপুর অফিস জানায়, জেলা শহরের ক্লাব রোডে স্বপন শীল (৪৫) নামে এক সেলুন শ্রমিক হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন। রবিবার দিবাগত রাতে শিকারপুরস্থ বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়লে ভোরের দিকে তার মৃত্যু ঘটে। স্বপনের শ্যালক সেলুন শ্রমিক দুলাল শীল জানান, তার ভগ্নিপতি সারাদিন সেলুনে গরমের মধ্যে কাজ করে ঘরে ফিরে রাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।