১২ বছরের পর কেন শিশুরা মায়ের ‘অবাধ্য’

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:০১, বুধবার, ১১ মে, ২০২২, ২৮ বৈশাখ ১৪২৯
ফাইল ফটো
ফাইল ফটো

গবেষকরা বলছেন, একটা বয়সের পর মায়ের কণ্ঠের গুরুত্ব কমে যাওয়ার ভালো দিকই বেশি। কারণ এই প্রক্রিয়া কিশোর-কিশোরীদের বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হতে সাহায্য করে, সংযোগ তৈরি করে। পরিবারের বাইরে তাদের সামাজিকভাবে পারদর্শী করে তোলে।

 

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুরা অপরিচিত কণ্ঠের দিকে আকৃষ্ট হয়। ১২ বছর পার হলেই ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারায় সবচেয়ে কাছের স্বজন মায়ের কণ্ঠস্বর।

বিষয়টি একদমই প্রাকৃতিক বলে প্রমাণিত হয়েছে গবেষণায়। তবে অনেক পরিবার একে ভেবে নেয় শিশুর ‘অবাধ্য’ হওয়ার লক্ষণ হিসেবে।

জার্নাল অফ নিউরোসায়েন্সে প্রকাশিত গবেষণার ফল বলছে, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ প্রক্রিয়ায় টিনএজ শিশুরা অন্যদের কণ্ঠস্বরকে আমলে নিতে শুরু করে বলেই মায়ের কণ্ঠ বাড়তি গুরুত্ব হারাতে শুরু করে।

‘তুমি কি আমার কথাও শুনছ’- মায়েরা অহরহ এমন প্রশ্ন টিনএজারদের করে থাকেন। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা এর সঠিক জবাব দিলে উত্তরটি ‘না’ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

আর এই ‘না’ এর পেছনে সত্যিই টিনএজারদের কোনো দায় নেই। বয়ঃসন্ধিকালের শিশুদের মস্তিষ্কের ওপর নতুন গবেষণা বলছে, কিছু কণ্ঠস্বরের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া সময়ের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই বদলে যায়। একটা সময়ে মায়ের কণ্ঠস্বরও কিশোর-কিশোরীর কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

শিশুদের মস্তিষ্ক স্ক্যান করে দেখা গেছে, ১২ বছর বা তার কম বয়সীদের স্নায়ু মায়ের কণ্ঠস্বরের প্রতি ভীষণভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। সক্রিয় হয়ে ওঠে মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টারস এবং আবেগ-প্রক্রিয়া করার কেন্দ্রগুলো।

তবে এরপর শিশুদের মস্তিষ্কে বেশ পরিবর্তন আসে। এ সময়ে মায়ের কণ্ঠ আগের মতো মস্তিষ্ককে আর আন্দোলিত করে না। এর পরিবর্তে অন্যসব কণ্ঠে (পরিচিত বা অপরিচিত) তাদের মস্তিষ্ক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে।

এই পরিবর্তন এতটাই স্পষ্ট যে গবেষকরা মায়ের কণ্ঠের ভিত্তিতে প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে শিশুদের বয়স অনুমান করতে পেরেছেন।

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির মনোচিকিৎসক ড্যানিয়েল অ্যাব্রামস বলেন, ‘একটি শিশু যেমন তার মায়ের কণ্ঠে আন্দোলিত হয়, তেমনি একজন কিশোর নতুন কণ্ঠেও আকৃষ্ট হয়।

‘একজন কিশোর হিসেবে আপনি জানেন না যে আপনি এটি করছেন। আপনি নতুন বন্ধু এবং সঙ্গী পেয়েছেন। তাদের সঙ্গেই আপনি সময় কাটাতে চান। আপনার মন ক্রমে সংবেদনশীল এবং আকৃষ্ট হচ্ছে অপরিচিত কণ্ঠের দিকে।’

গবেষকরা বলছেন, এটি কিশোর মস্তিষ্কের সামাজিক দক্ষতা তার বিকাশের লক্ষণ। একজন কিশোর ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের পরিবার থেকে দূরে সরে যায় না; তাদের মস্তিষ্ক একটি সুস্থ উপায়ে পরিপক্ব হওয়ার কারণেই এই পরিবর্তনটি ঘটে।

গবেষণা বলছে, একজন মায়ের কণ্ঠস্বর শিশুর স্বাস্থ্য এবং বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিশুদের মানসিক চাপের মাত্রা, সামাজিক বন্ধন, খাওয়ার দক্ষতা এবং কথা বলার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। তবে একপর্যায়ে মায়ের কণ্ঠের চেয়ে অন্য সব কণ্ঠ তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির স্নায়ুবিজ্ঞানী বিনোদ মেনন বলেন, ‘যখন কিশোর-কিশোরীরা তাদের বাবা-মায়ের কথা শোনে না, তখন তাদের অনেকে ভুল বুঝতে পারেন। তবে এর আসল কারণ একেবারেই ভিন্ন। তারা বাড়ির বাইরের কণ্ঠের প্রতি আরও মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়।’

২০১৬ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১২ বছরের কম বয়সী শিশুদের মস্তিষ্ক তাদের মায়ের কণ্ঠের সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িত।

পরে গবেষকদলটি ১৩ থেকে সাড়ে ১৬ বছর বয়সী ২২ কিশোর-কিশোরীর ওপর পরীক্ষা চালায়। এতে দেখা গেছে, মায়ের কণ্ঠস্বর তাদের মস্তিষ্কে তেমন প্রভাব ফেলেনি। এর পরিবর্তে কিশোর-কিশোরীদের শোনা সব কণ্ঠ তাদের শ্রবণ প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত নিউরাল সার্কিটকে সক্রিয় করে। মস্তিষ্ক তখন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাছাই করে এবং তৈরি করে সামাজিক স্মৃতি।

স্ট্যানফোর্ডের গবেষকরা বলছেন, যেসব শিশু অটিজমে আক্রান্ত, তারা তাদের মায়ের কণ্ঠস্বরের প্রতি তেমন শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখায় না। অন্তর্নিহিত নিউরোবায়োলজিক্যাল প্রক্রিয়াটি আরও ভালো করে বোঝা গেলে সামাজিক বিকাশের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হওয়া যাবে।

মেনন বলেন, ‘একটি শিশু একপর্যায়ে স্বাধীন হয়ে ওঠে। এটি একটি অন্তর্নিহিত জৈবিক সংকেত।

‘এটাই আমরা উদ্ঘাটন করেছি। এটি একটি সংকেত, যা কিশোর-কিশোরীদের বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হতে সাহায্য করে, সংযোগ তৈরি করে। যা তাদের পরিবারের বাইরে সামাজিকভাবে পারদর্শী করে তোলে।’

বিষয়ঃ গবেষণা

Share This Article