পাকিস্তানে বিলুপ্তপ্রায় পাল্লা, শেষ ভরসা বাংলাদেশের ইলিশ!

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ দুপুর ০১:০০, শনিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২১, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪২৮
ফাইল ফটো
ফাইল ফটো

জান্নাতুল নাঈম পিয়াল: এই মাছের সাঁতারের কৌশল অন্য অধিকাংশ মাছের মতো নয়। তীব্র স্রোতের বিপরীতেও এটি সোজা লাইন বরাবর সাঁতার কাটে। ফলে এই মাছ ধরা সহজ কাজ নয়।

 

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, পাকিস্তানের সিন্ধু নদে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ত একটি বিশেষ মাছ, নাম যার পাল্লা। জেলেদের জালে ধরা পড়া পাল্লা পরিমাণে এতটাই বেশি হতো যে, স্থানীয়দের কাছে বিনে পয়সাও প্রচুর মাছ বিলি করতে পারতেন জেলেরা।

কিন্তু তারপরও, 'ফ্রি' মানেই যে জিনিস সবসময় খারাপ হবে, এমন তো কোনো কথা নেই। আরব সাগর থেকে সিন্ধু নদে প্রবেশ করা পাল্লার বেলায়ও সে কথা প্রযোজ্য। এই মাছ ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রিয়। পাল্লা মাছ ভাজা কিংবা অন্যান্য নানা পদ খেয়েই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতেন লাখো পাকিস্তানি।

এতটাই জনপ্রিয় ছিল এই মাছ যে, প্রতি সপ্তাহান্তে পাকিস্তানের বাণিজ্যিক রাজধানী করাচি থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে যেত পার্শ্ববর্তী হায়দরাবাদ, জামশোরো ও ঠাট্টা জেলায়। সেখানে গিয়ে সিন্ধু নদের পাড়ে, বিভিন্ন রোডসাইড রেস্তোরাঁয় বসে তারা আশ মিটিয়ে খেত পাল্লা।

কেন পাল্লা মাছের এত জনপ্রিয়তা, কী-ই বা এর বিশেষত্ব, তা ব্যাখ্যায় খুব বেশি কিছু বলার দরকার নেই। শ্যাড গোত্রের মাছ এটি। আরও পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, আমাদের বাংলাদেশে যে মাছ পরিচিত 'ইলিশ' নামে, সেটিকেই পাকিস্তানে ডাকা হয় 'পাল্লা' নামে। তা হলে বুঝতেই পারছেন, পাল্লা কেন ছিল পাকিস্তানের মানুষের এত প্রিয়!

তবে খেয়াল করে দেখেছেন নিশ্চয়ই, উপরে বারবার অতীত কালসূচক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেছি। এর কারণ কী?

আসলে সিন্ধু নদের পাড়ের সেই রেস্তোরাঁগুলো এখনও আছে ঠিকই, এবং সেখানে এখনও বসে হরেক রকম মুখরোচক খাবারের পসরা, কিন্তু ক্রমহ্রাসমান পাল্লা মাছের প্রাপ্তি। এখন আর নেই এ মাছের ভরভরন্ত দশা, স্বর্ণালি সময়। ধীরে ধীরে এটি পরিণত হচ্ছে ডুমুরের ফুলে। আগে যেখানে একেকটি স্থানীয় জেলে নৌকা দিনে গড়ে কয়েক টন করে পাল্লা ধরত, সেখানে বর্তমানে তা নেমে এসেছে দৈনিক ৫০ থেকে ১০০টি মাছে।

পাল্লা মাছের বিলুপ্তির পথে ধাবিত হওয়ার পেছনে কারণ রয়েছে বেশ কিছু। প্রথম কারণ সিন্ধু নদের পানির স্তর নেমে যাওয়া। এদিকে সিন্ধু বদ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা অবৈধ জাল ফেলেও ধরে নেয় অসংখ্য অপরিণত, ছোট মাছ।

জামশোরোর ইউনিভার্সিটি অব সিন্ধের প্রাকৃতিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ওয়াজির আলি বালুচের মতে, সিন্ধু নদের পানির পরিমাণ গত কয়েক বছর ধরে একটানা কমেই চলেছে। ফলে সাগর থেকে সিন্ধু নদের পানিতে পাল্লা মাছের ভ্রমণের গতিপথও ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। এর ফলে অবৈধ জাল দিয়ে সহজেই ধরে ফেলা যাচ্ছে মাছ, সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না তাদের বংশবৃদ্ধির।

মূলত পাল্লা মাছ সিন্ধু নদ থেকে প্রজননের উদ্দেশ্যে সাগর থেকে সিন্ধু নদে আসে, এখানে দুই থেকে তিন মাস থাকে, এরপর আবার ফিরে যায় সাগরে। পরের বছর ফের সিন্ধু নদে প্রত্যাবর্তন ঘটে তাদের। অন্তত কয়েক দশক আগ পর্যন্ত এমনটিই ছিল তাদের জীবনচক্র। কিন্তু বর্তমানে ছেদ পড়েছে তাদের সেই স্বাভাবিক জীবন-প্রবাহের ছন্দে।

"মাত্র কয়েক দশক আগেও, প্রচুর পরিমাণ পানি এসে ভরিয়ে দিত সিন্ধুর খাঁড়িগুলোকে। ফলে বৈধ-অবৈধ দুই উপায়েই পাল্লা ধরা ছিল দুরূহ ব্যাপার। এতে করে বিপুল সংখ্যক পাল্লা সাগরে ফিরে যেতে পারত, আবার পরের বছর ফিরেও আসত," বালুচ বলেন।

"কিন্তু এই গোটা চক্রই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিঠাপানির অপ্রতুলতার পাশাপাশি অবৈধভাবে মাছ ধরার কারণে। পানি-স্বল্পতার কারণে পাল্লা এখন সিন্ধুর মাত্র অল্প কয়েকটি শাখাতেই সীমাবদ্ধ। তাছাড়া এরা শুধু সংখ্যাতেই হ্রাস পায়নি, জাল দিয়ে এদের ধরাও হয়ে পড়েছে অতি সহজ ব্যাপার।"

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, খুব কম পরিমাণ পাল্লাই জালের ফাঁদ এড়িয়ে কোটরি বাঁধ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এই বাঁধের আশপাশের জায়গা হলো ২৮৫ কিলোমিটার জুড়ে পাল্লা মাছের প্রজননের অবাধ অঞ্চল। তবে বালুচ এ কথাও জানিয়েছেন, "খুব কম পরিমাণ" মাছই প্রজনন শেষে সাগরে ফিরতে সক্ষম হয়।

কোস্টাল কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন নামের একটি বেসরকারি সংস্থা কাজ করে জেলেদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে। এই সংস্থার প্রধান আমির জাত জানান, খাঁড়ির মুখে অসংখ্য নিষিদ্ধ জাল বসানোর কারণেই পাল্লা মাছ সহজে সিন্ধু নদে প্রবেশ করতে পারে না।

"১৯৯০-র দশকের গোড়ার দিক পর্যন্ত জুন থেকে আগস্ট মৌসুমে প্রতিটি জেলেই আগে কয়েকশো মাছ ধরতে পারতেন। কিন্তু আজকাল সেই সংখ্যা পাঁচ থেকে দশের বেশি নয়।"

আরব সাগরের মুখে অবস্থিত সিন্ধু বদ্বীপ পাল্লা মাছের প্রধান ভ্রমণ গতিপথ। এটির সাঁতারের কৌশলও অন্য অধিকাংশ মাছের মতো নয়। তীব্র স্রোতের বিপরীতেও এটি সোজা লাইন বরাবর সাঁতার কাটে। ফলে এই মাছ ধরা সহজ কাজ নয়। জেলেদের ব্যক্তিগত দক্ষতার যেমন প্রয়োজন হয়, তেমনই দরকার হয়  বিশেষভাবে নির্মিত জাল।

যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, পাকিস্তানের পাল্লা বাংলাদেশের ইলিশেরই একটি সংস্করণ। এছাড়া মিয়ানমার ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও পাওয়া যায় ইলিশ। গুজরাটে একে ডাকা হয় মোদেন ও পালভা নামে।  তেলেগু ভাষায় এর নাম পোলাস, তামিলে ওলাম, কন্নড় ভাষায় পালিয়া, মারাঠিতে পলা।  ইরাকে এটি স্বুর, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে এটি তেরুবক নামে পরিচিত। নামে যেমন ভিন্নতা আছে, একেক অঞ্চলের পাল্লা বা ইলিশের স্বাদেও থাকে উল্লেখযোগ্য তফাৎ।

পাল্লা যে শুধু সিন্ধু নদেই পাওয়া যায়, তা কিন্তু নয়। সিন্ধু নদের নিকটবর্তী সুক্কুর নদী, যেটি করাচি থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে, সেখানেও বন্যার পানিতে ভেসে যায় পাল্লা। আবার ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের আগে (১৯৪৭ সালে), এই প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত মুলতানেও, যেটি করাচি থেকে ৯০০ কিলোমিটার দূরে।

এটি সম্ভব ছিল, কেননা তখনকার দিনে নদী ছিল অবমুক্ত। কিন্তু এরপর থেকে গত সাত দশকে সিন্ধু নদে প্রচুর খাল কাটা ও বাঁধ নির্মাণের ফলে সিন্ধু প্রদেশের মাছ আর বাইরের প্রদেশে যেতে পারে না।

বালুচের মতে, পাকিস্তানের পাল্লা মাছকে যদি বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে হয়, তাহলে সিন্ধু নদের পুনর্বাসন ও পুনরুদ্ধার আবশ্যক। তাছাড়া এর অন্যথায় ক্রমবর্ধমান সমুদ্রক্ষয়ও আটকানো যাবে না বলে মনে করেন তিনি।

বালুচের সুপারিশ হলো, নদীর নিম্নস্রোতের জন্য ১০ মিলিয়ন একর-ফুট পানির বরাদ্দ রাখতে হবে, পাশাপাশি অন্য কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে। যেমন: পাল্লার প্রজননের মৌসুমে নির্দিষ্ট অঞ্চলে পাল্লাসহ অন্য যেকোনো ধরনের মাছ ধরাই নিষিদ্ধ করতে হবে, অভিবাসী মাছের নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করতে হবে।

পাকিস্তানের ১৯৯১ সালের পানি-চুক্তি অনুযায়ী, নদীর বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের জন্য প্রতি বছর কোটরি, সিন্ধুর নিম্নস্রোত থেকে প্রতি বছর ৫ মিলিয়ন একর-ফুট পানি আরব সাগরে পতিত হতে হবে।

সিন্ধু প্রদেশ জুন ও জুলাই মাসে পাল্লা মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে বটে, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সেই নিষেধাজ্ঞা সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না।

হায়দরাবাদের ন্যাশনাল হাইওয়ের দুই ধারের সারিবাঁধা রেস্তোরাঁগুলোতে এখনও পাল্লা মাছ পাওয়া যায়। কিন্তু সেসব মাছ আসলে পাকিস্তানের স্থানীয় পাল্লা নয়। বরং সেগুলো "ভিন্ন জাতের" পাল্লা।

এ ব্যাপারে আমির জাত জানান, "এগুলো এক ধরনের অনভিবাসী জাতের পাল্লা, যেগুলো পাকিস্তান ও ইরানের উপকূলীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়। আসল পাল্লার সঙ্গে এদের স্বাদের কোনো মিল নেই।"

আর শুধু উপকূলীয় পাল্লাই বা কেন, কোনো কোনো পাকিস্তানি রেস্তোরাঁ নিজেদের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে এখন শেষ ভরসার স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে বাংলাদেশের ইলিশকেও! ভারতীয় ইলিশের নানা সংস্করণও রাখে কেউ কেউ।

এসব ইলিশের সাহায্যেই, এখনও নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পেরেছে পাল্লা বিক্রি করে একসময় জনপ্রিয়তা পাওয়া ওইসব রেস্তোরাঁ। তবে কখনও যদি দেশটি থেকে একদমই বিলুপ্ত হয়ে যায় পাল্লা, তাহলে রেস্তোরাঁ মালিকদের গোমরও যে ফাঁস হয়ে যাবে, সে কথা বলাই বাহুল্য

টিবিএস বাংলা

বিষয়ঃ খাদ্য

Share This Article