যা দেখবেন সিকিম ভ্রমণে, যেসব তথ্য প্রয়োজন

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ বিকাল ০৫:৩৪, শনিবার, ৭ মে, ২০২২, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯

ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য সিকিম। তবে বিশাল তার সৌন্দর্যের ভান্ডার। প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পর্যটন শহর সিকিম। ভারতের উত্তর পূর্বে অবস্থিত সিকিমকে ঘিরে আছে পশ্চিমবঙ্গ, ভূটান, নেপাল এবং তিব্বত। বাংলাদেশ থেকে সহজে ও কম খরচে ভ্রমণ করা যায় বলে পর্যটকদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে সিকিমের অবস্থান।

সিকিমের ইতিহাসের সূচনা প্রাচীন হিন্দু এবং তিব্বতীদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম শুরু হয়। তারপরে ১৭ শতকে বৌদ্ধ রাজ্য বা ছোগিয়াল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তিব্বতের সাথে বাণিজ্যপথ স্থাপনের চেষ্টা করেছিল, যার ফলে সিকিম ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অবধি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। ১৯৭৫ সাল অবধি রাজা রাজাদের দ্বারা শাসিত একটি স্বাধীন দেশ ছিল সিকিম। এরপরে ১৯৭৫ সালের ১৬ই মে গনভোটের মাধ্যমে সিকিম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।

পাহাড়ের প্রকৃতি, চোখধাঁধানো তুষারশৃঙ্গ, নজরকাড়া নদী ও ঝর্না, মনোমুগ্ধকর সরোবর, গভীর অরণ্য, নানারকমের পাখি ও জন্তু-জানোয়ার, দৃষ্টিনন্দন অর্কিড-ক্যাকটাস-ফুল দেখা যাবে সিকিম ভ্রমণে। বরফে মোড়া এই জণপদটি  ভ্রমণ পিপাসুদের অনেক পছন্দের। সাত হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সিকিমের মোট জনসংখ্যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ছয় লাখ। সিকিম ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা কম জনবহুল। উত্তর সিকিম, পূর্ব সিকিম, দক্ষিণ সিকিম এবং পশ্চিম সিকিম এই চার জেলার সমন্বয়ে গঠিত সিকিম চমৎকার পাহাড়ি ঝর্ণা, গভীর উপত্যকা, ঔষধি গাছের বন এবং সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য পরিপূর্ণ। আলপাইন চারণভূমি, পাহাড়, হিমবাহ ও হাজারো বুনো ফুলে ভরা সিকিমের গ্যাংটক ও লাচুংয়ের মতো উপশহরের প্রতিটি স্থান পর্যটকদের মুগ্ধ করে। আর পুর্ব সিকিমের অপার সৌন্দর্যের ধারক সাঙ্গু লেক এই শহরের আরেক বিশেষ আকর্ষণ।

সিকিম। ছবি: সংগৃহীত

সিকিম। ছবি: সংগৃহীত

সিকিমের সৌন্দর্য ও দর্শনীয় স্থান:

গ্যাংটক

সিকিম রাজ্যের রাজধানী শহর হলো গ্যাংটক। গোটা শহরটি যেন পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছে। সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই শহরে শপিং মল, ক্যাসিনো, সিনেমা হল, ভিডিও পার্লার, সাইবার কাফে, কিউরিও শপ, জামাকাপড় ও ইলেকট্রনিক্সের দোকান ইত্যাদি আধুনিক শহরের সব উপাদানই আছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে আছে এম জি মার্গ (মহাত্মা গাঁধী মার্গ)। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেরে নিতে পারেন প্রয়োজনীয় কেনাকাটা। দূরের আকাশে উপস্থিত কাঞ্চনজঙ্ঘা হয়তো তখন দ্যুতি ছড়াচ্ছে। রোপওয়ে চড়ে আকাশপথেও দেখে নিতে পারেন গ্যাংটক ও চারপাশের দৃশ্য।

গুরুডোংমার লেক

এই প্রশান্ত হ্রদের উজ্জ্বল ফিরোজা রঙের আভা পাশাপাশি এর চারপাশে উত্তর-পূর্বের প্রাণবন্ত সংস্কৃতি এটি সিকিমের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা স্থান করে তুলেছে। এই লোভনীয় হ্রদটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭ হাজার ৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। গুরুডোংমার লেকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যটি হলো, এটিকে কেবল একটি ধর্মই নয় বরং তিনটি হিন্দু, শিখ এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা মিলন স্থল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বরফে ঢাকা পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় এই লেক থেকে।

সাঙ্গু লেক

সাঙ্গু হ্রদটি সিকিমের রাজধানী থেকে মাত্র ৩৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, গ্যাংটক, সিকিমের সর্বাধিক জনপ্রিয় পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে একটি। বরফে ঢাকা এই লেকের সৌন্দর্য খুব সুন্দর।

যদি পূর্ব সিকিমে বেড়াতে সেরা জায়গাগুলো সন্ধান করছেন তবে আপনার ভ্রমণের সময় অবশ্যই এই জায়গাটি ঘুরে দেখতে হবে। পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা আপনাকে মহিমান্বিত করবে।

লাচুং, ইয়ামথাং ভ্যালি

লাচেন বা লাচুং উত্তর সিকিমের একটি দুরের গ্রাম। তিব্বতী যাযাবর উপজাতিদের বসবাস এই গ্রামে। ইয়মথ্যাং হলো পাহাড় দ্বারা আবদ্ধ একটি সুন্দর উপত্যকা। যেখানে গেলে দেখতে পাবেন পাহাড়ি ফুল। রঙিন ফুলে ঘেরা লেক। উত্তর সিকিমের দেখার জন্য এবং সিকিমের তুষারপাতের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এটি সবচেয়ে বিখ্যাত একটি স্থান। গুরুডোংমার লেক থেকে লাচুং যাওয়ার পথটি আপনাকে অ্যাডভেঞ্চার দেবে।

জুলুক

সিকিমের অফবিট পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে একটি জুলুক। বেশ উচ্চতায় অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম এটি। শীতকালে তুষারপাতযুক্ত পর্বতশ্রেণির দুর্দান্ত দৃশ্যের জন্য এটি জনপ্রিয়। জুলুকের পাহাড়ি পথ কুয়াশায় আচ্ছন্ন। দেখার জন্য এটি বেশ দুর্দান্ত জায়গা। 

সিকিম। ছবি: সংগৃহীত

সিকিম। ছবি: সংগৃহীত

নাথুলা বর্ডার

গ্যাংটকের মূল শহর থেকে প্রায় ৫৩ কিলোমিটার দূরে নাথুলা বর্ডারের অঞ্চলটি অবস্থিত। এটি সিকিমের রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন স্থান। এই জায়গার চারপাশে ভারতীয় এবং তিব্বতীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণ চোখে পড়ে। একটি বিখ্যাত সীমান্ত বাজার শেরাথাং অবস্থিত। সেখান থেকে আপনি নিজের এবং বন্ধুদের জন্য তিব্বতী জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে পারবেন। তবে অনেক সময় নাথুলা বর্ডার এ যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায় না।

তিস্তা নদী

তিস্তা নদী দর্শনার্থীদের জন্য বেশ আনন্দের। তার চকচকে প্রান্তর আপনার মনকে প্রশান্ত করে তুলবে। তিস্তা নদীর ধার ধরে প্রচুর পাথর ও ফুলের সমাবেশ তৈরি হয়েছে। কনকনে ঠাণ্ডা জলে পা ডুবিয়ে আনন্দ নিতে চান অনেক ভ্রমণপ্রেমী মানুষ।

পেলিং

পশ্চিম সিকিমের একটি ছোট্ট শহর পেলিং। স্কাই ওয়াক পেলিং এ পাহাড়ের ওপর ঝুলন্ত ৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ব্রিজ দিয়ে মন্দিরে যাওয়ার ভিন্ন অভিজ্ঞতা কোনো এডভেঞ্চারের চেয়ে কম নয়। রিম্বি নদীর পাশের রিম্বি অরেঞ্জ গার্ডেনে এলাচ, কমলা, কাঠ বাদাম ও কমলার গাছ দেখতে পারবেন, জনপ্রতি এখানে এন্ট্রি ফি ১০ রুপি। কাঞ্ছনজঙ্গা ফলসের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে অনেকেই এখানে আসেন। 
আবার রাবদেন্তসে রুইন্স এর মতো ঐতিহাসিক জায়গায় ২৫ রুপির বিনিময়ে ট্র্যাকিং করতে পারবেন। পশ্চিম সিকিমের প্রায় তিন শত বছর পুরনো সুন্দর পেমায়াংতসে মোনাস্টি এর স্থাপত্যশৈলীও পর্যটকদের বেশ আকর্ষণ করে।

ইয়ুকসোম 

পশ্চিম সিকিমের একটি ঐতিহ্যবাহী শহর যেখানে কাঞ্জনজঙ্খা ঝর্না, ছোট ছোট লেক ও বৌদ্ধ মন্দির আছে। হাইকিং করার ও সুযোগ আছে এখানে।

সিকিমে রয়েছে আরো বিশেষ কিছু স্থান, যেমন নামছি, জিরো পয়েন্ট, রুমটেক মনেস্ট্রি,মংগং, কাঞ্চনজঙ্ঘা বেস ক্যাম্প, থাঙ্গু, হনুমান টক, বাবা হরভজং সিং এর মন্দির, গেজিং ইত্যাদি।

যেভাবে যাবেন সিকিম

সিকিম যাওয়ার জন্য প্রথমে বাসে করে ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা যেতে হবে। বাংলাবান্ধায় বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন শেষ হলে ইন্ডিয়ান বর্ডারের ইমিগ্রেশন শেষ করে অটোতে ফুলবাড়ি বাসস্ট্যান্ড যেতে হবে। ফুলবাড়ি থেকে বাসে ১০ রুপি খরচ করে শিলিগুড়ি পৌঁছাতে হবে। শিলিগুড়িতে পৌঁছেই Sikkim Nationalized Tranport (SNT) অফিস গিয়ে সিকিম ভ্রমণের অনুমতি নিতে হবে। অন্তত ১০ দিনের অনুমতি নেওয়া ভালো। 

এরপর শিলিগুড়ি থেকে সিকিমের রাজধানী শহর গ্যাংটকের দূরত্ব ১১৪ কিলোমিটার। সড়ক পথে শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক যেতে প্রায় ছয় ঘণ্টা সময় লাগবে। শিলিগুড়ির সিকিম ন্যাশনালাইজড ট্রান্সপোর্ট বাস টার্মিনাল কিংবা NJP স্টেশন থেকে শেয়ার গাড়ি ভাড়া নিলে জনপ্রতি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা খরচ হবে। বাস ভাড়া লাগবে জনপ্রতি ১২০ টাকা।

সিকিম যাওয়ার গাড়ি ভাড়া করার ক্ষেত্রে সিকিমের রেজিস্ট্রিত গাড়ি ভাড়া করার চেষ্টা করুন। ওয়েস্ট বেঙ্গল কিংবা অন্য রাজ্যের রেজিস্ট্রেশনের গাড়ি গ্যাংটক সিটি সেন্টারের দেওরালিতে নামিয়ে দেবে। তখন আপনাকে আবার গাড়ি ভাড়া করে আসতে হবে।

সিকিম। ছবি: সংগৃহীত

সিকিম। ছবি: সংগৃহীত

সিকিম ভ্রমণ খরচ

ঢাকা থেকে বাসে বাংলাবান্ধা যেতে জন প্রতি ভাড়া ৭০০ টাকা। আর ইমিগ্রেশন ও ট্যাক্সি ভাড়াসহ সিকিমে যেতে জনপ্রতি দুই হাজার টাকা খরচ হবে। আবার নর্থ সিকিমের বিভিন্ন প্যাকেজের মাধ্যমে লাচুং ও ইয়ামথাং ভ্যালি ঘুরার জন্য খরচ পড়বে ১১ হাজার থেকে ১৪ হাজার রুপি।

সিকিমে খাওয়া দাওয়া, যাতায়াত ও ঘুরাঘুরি বাবদ ৬ দিন ৭ রাত থাকতে জনপ্রতি ১৬ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার মতো লাগবে। তবে সিকিমে ৬ থেকে ৭ জনের গ্রুপ করে যাতায়াত করলে ও হোটেল রুম শেয়ার করলে খরচ অনেক কম হবে।

সিকিমে কোথায় থাকবেন

সিকিমের গ্যাংটক, পেলিং, লাচুং ও এম জি মার্গে থাকার জন্য অসংখ্য হোটেল, মোটেল এবং হোমস্টে আছে। হোটেল অনুযায়ী দুই বেডের ভাড়া লাগবে দেড় হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। তবে পর্যটন মৌসুমে হোটেল ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে যায়। একটু খোঁজখবর করলে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে দুইজন রাত্রিযাপনের মতো কক্ষও পাওয়া যাবে। গ্যাংটকের কিছু হোটেলের তথ্য –

হোটেল প্রিয়দর্শিনী: ফোন: ৯৮৩৬৫৫৬১৩৯, ৯৪৩৩০৬৭৬৭৩।
হোটেল উইলিস: ফোন ৮১৭০০-৬৭৯৫২, ৭৫৫৭০-৮৬৬৫২।
সোয়াংগ হোটেল: ফোন ৮২৫০৮৯৩৩১৫।
নিউ হোটেল সিকিম: ফোন ৯০৫১১৬৬৬৯৩

সিকিমে ঘুরতে যাওয়ার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

অবশ্যই নিজের পাসপোর্ট, ভোটার আইডি কার্ড সঙ্গে রাখুন। কারণ, সিকিমে চেক পোস্ট এ আপনার এবং আপনার পরিবারের প্রমাণ পত্র চেক করা হবে।

সিকিমে আবর্জনা বা থুতু ফেলা অপরাধ। এই জিনিসগুলো এড়িয়ে চলুন।

সিকিমের বর্ডার এলাকায় সাবধানে চলাচল করুন। মনে রাখার মতো নাথুলা বর্ডার ও জিরো পয়েন্টের মতো জায়গায় বিদেশীদের প্রবেশ নিষেধ।

সপ্তাহে পাঁচ দিন (বুধ থেকে রবিবার) যাওয়া যায় ছাঙ্গু-নাথুলা-বাবামন্দির। শুধু ছাঙ্গু লেক যেতে চাইলে অবশ্য সব দিনই যাওয়া যায়। দুকপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি ও এক কপি ভোটার আইডির ফটোকপি দিয়ে আবেদন করলে সহজেই মেলে এই অনুমতিপত্র। গ্যাংটকের হোটেল কিংবা ওখানকার যে কোনো ট্রাভেল এজেন্সির অফিসও ব্যবস্থা করে দিতে পারবে প্রয়োজনীয় অনুমতির।

Share This Article