পরস্পরের 'গণতন্ত্র শেখাতে' মুখোমুখি যুক্তরাষ্ট্র-চীন

গণতন্ত্রের চর্চা নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।
গণতন্ত্রের চর্চা নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। পরস্পরের শাসননীতি নিয়ে পাল্টাপাল্টি মন্তব্যে দুই দেশকে কেন্দ্র করে নতুন ধরনের বৈশ্বিক মেরূকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডাকা বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক সম্মেলনে গণতন্ত্র, মুক্ত গণমাধ্যম ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নবজাগরণ ঘটানোর কথা বলেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তার দৃষ্টিতে- গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিচ্ছে কর্তৃত্ববাদ। এর বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক বিশ্বকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে এক প্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় মানবাধিকার দিবসে চীন, মিয়ানমার, উত্তর কোরিয়াসহ কয়েকটি দেশের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নিজের কঠোর অবস্থান জানান দিয়েছেন তিনি। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বেইজিং।
যুক্তরাষ্ট্রের মডেলের গণতন্ত্রকে চীন শুধু চ্যালেঞ্জই করছে না; তারা বলছে- একে তারা গণবিধ্বংসী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের মাধ্যম হিসেবে এই অস্ত্র ব্যবহার করে ওয়াশিংটন। বিশ্বজুড়ে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতেই তাদের এই গণতন্ত্র সম্মেলন।
যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মডেল বা এ বিষয়ে তাদের উচ্চবাচ্যের বিরুদ্ধে এভাবে কখনও প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়নি চীনকে। চীনা নেতাদের পাশাপাশি তাদের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যাখ্যাকে প্রত্যাখ্যান করে সরাসরি বিরোধিতায় নেমেছে। পরস্পরকে গণতন্ত্র শেখাতে উঠেপড়ে লেগেছে তারা।
চীনের এই প্রকাশ্য বিরোধিতাকে 'অপপ্রচার' হিসেবে অভিহিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা চীনকে কর্তৃত্ববাদী ও মানবাধিকারের প্রতি অসহিষুষ্ণ রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দুই দেশের এই মতাদর্শিক ভিন্নতার কারণে সৃষ্ট উত্তেজনা অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। কূটনৈতিক বিশ্বেও দোদুল্যমানতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
১১০টি দেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ডাকা ভার্চুয়াল গণতন্ত্র সম্মেলন শেষ হয়েছে গত শুক্রবার। এ ধরনের সম্মেলন বিশ্বে এই প্রথম। তবে সম্মেলনে অংশ নেওয়া সব দেশেরই গণতন্ত্র যে ফুলে-ফেঁপে উঠছে, তা নয়। ডাক পেয়েও সম্মেলনে যায়নি পাকিস্তান। আর যাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, তাদের পক্ষ নিয়ে চীন বলছে, ডাকেনি তো ভালোই হয়েছে। তার সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে রাশিয়া। চীনের প্রভাব বলয়ে থাকা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো চুপ থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক দীক্ষায় তারা যে হঠাৎ জেগে উঠবে, তা মনে হচ্ছে না। সরাসরি নাম উল্লেখ না করলেও তাদেরকেই কর্তৃত্ববাদী তকমা দিচ্ছে ওয়াশিংটন। এই সুযোগে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে চীন তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে।
চীন-রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে লড়াইয়ে নেমেছে যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশ। যদিও ফ্রান্সের অবস্থান কিছুটা ভিন্ন। দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোন বলেছেন, তারা দেখেশুনে পা ফেলবেন।
বার্তা সংস্থা এএফপি গতকাল এক খবরে জানায়, বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার উত্থানের মধ্যেই মিত্র ও একই মতের দেশগুলোকে নিয়ে গণতন্ত্র সম্মেলন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সম্মেলনে অনাহূত চীন-রাশিয়া বাইডেনের বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধের মতাদর্শগত বিভেদ সৃষ্টির অভিযোগ তুলেছে। গতকাল শনিবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, বিভিন্ন দেশে 'রঙিন বিপ্লব' উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। মতাদর্শগত বিভেদের সীমা টানা, গণতন্ত্রকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কৌশল এবং বিভাজন ও সংঘাত উস্কে দিতেই তারা এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে। এর পরিবর্তে 'ছদ্মবেশ ধরে থাকা গণতন্ত্রকে কঠোরভাবে প্রতিরোধ ও এর বিরোধিতা করা'র প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বেইজিং। বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ঘিরে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের মহড়া হিসেবে দেখছেন অনেকে।
গতকাল চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্ৃব্দত করে বলেছে, অভ্যন্তরীণ সমস্যা আড়াল করতেই বাইডেন গণতন্ত্রের জিগির তুলেছেন। মূল্যস্ম্ফীতিসহ অর্থনৈতিক ধীরগতি, অভ্যন্তরীণ খুনোখুনি, গণতন্ত্রের নামে ধনীদের হাতে সম্পদ তুলে দেওয়ার মতো ব্যর্থতা ঢাকতেই এ কাজে নেমেছেন। শাসননীতিতে বদল এনে আরও ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এ বিষয়ে কথা না বললেও তার মন্ত্রী ও কূটনীতিকরা কোমর বেঁধে নেমেছেন।
'এক ব্যক্তি এক ভোট' ব্যবস্থাকে লোক দেখানো গণতন্ত্র বলে অভিহিত করেছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, এ ধরনের ব্যবস্থায় ভোটের পর রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের কোনো অধিকার থাকে না। তা ছাড়া এই গণতন্ত্রের সুফল ভোগ করে শুধু ধনিক শ্রেণি। তারা অর্থনীতির পাশাপাশি পার্লামেন্টও দখল করে। এটি জনগণের গণতন্ত্র নয়।
সম্প্রতি প্রকাশিত গণতন্ত্র সূচকে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্নগামী অবস্থান, ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ, ধনী আইনপ্রণেতাদের সংখ্যা বৃদ্ধিকে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক দুর্বলতা বলে প্রচার করছে চীন। গ্লোবাল সিজিটিএনের দাবি, এর চেয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র অনেক ভালো। চীনের এই বার্তা তাদের সব দেশ ও কূটনৈতিক মিশন থেকে প্রচার করা হচ্ছে। এই প্রচারকে অপপ্রচার আখ্যা দিয়ে পাল্টা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা। সূত্র :সিজিটিএন, নিউইয়র্ক টাইমস, এএফপি, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।