১৬৬ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর প্রাণ উৎস্বর্গ : রাজনীতি নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় সশস্ত্র বাহিনী!

রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কবল থেকে স্বশস্ত্র বাহিনীকে নিরাপদ রাখতে ভবিষ্যতে যদি তারা পাকিস্তানের মতো 'দেশের রাজনীতি' নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তবে দেশের যে ক্ষতি হবে তার জন্য কারা দায়ী থাকবেন? দেশের মানুষ কি তাদের কখনও ক্ষমা করতে পারবেন? স্বশস্ত্র বাহিনীও কি তাদের সম্মান ভুলুণ্ঠিতকারীদের ক্ষমা করবে?
এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বিদেশি কূটনীতিক আর শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি সৈন্য প্রসঙ্গ। দুটি উপাদানই অত্যন্ত স্পর্শকাতর হলেও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি সৈন্য না নেয়ার বিষয়টি শুধু স্পর্শ কাতরই নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শান্তিকামী মানুষের ভালোবাসা ও আবেগের বিষয়টিও।
"শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশি সৈন্যদের কি বাদ দেয়া উচিত?"- এমন প্রশ্ন যদি বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষকে করা হয়, আমি নিশ্চিত সাধারণ একজন মানুষকেও এর পক্ষে পাবেন না। এর যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক একটি বিতর্কিত মানবাধিকার সংগঠন 'এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল' শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশের সকল সৈন্য প্রত্যাহার চেয়েছে, নিজ দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে। তার চেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো আমাদের দেশের মাঠের অন্যতম প্রধান বিরোধীদল তাকে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু কেন?
এক কথায় এর উত্তর হলো, সশস্ত্র বাহিনীকে সরকারের ওপর ক্ষেপিয়ে তুলে কোনো অঘটন ঘটানো। দ্বিতীয় কোনো উত্তর নেই। কিন্তু তারা কি একবারও এর দীর্ঘমেয়াদী ভয়ংকর প্রভাবের কথা ভাবেননি, যা নিজেদেরকেও শেষ করে দিতে পারে? দেশের এবং জনগণেরও অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে, যা হয়তো যুগের পর যুগ বয়ে বেড়াতে হতে পারে, এমনকি দেশটিকে হয়তো চিরতরে উদীয়মান গণতন্ত্রের পথ থেকে ছিটকে পড়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়তে হতে পারে, যা কখনোই কাম্য নয়।
প্রথমত: ধরা যাক জাতিসংঘ কতৃক শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশি সৈন্য প্রত্যাহারের সম্ভাব্য চূড়ান্ত ঘোষণার আগেই (হুমকি ধামকি বা গুজবের পরিপ্রেক্ষিতে) কোন অঘটনের মাধ্যমে সরকার পতন হলো। এরপর নির্ধারিত নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার পরিবর্তন হবে, এমন নিশ্চয়তা কি রয়েছে? অন্য কোন গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাঝের সময়টিতে আবার কোনো অঘটনের মাধ্যমে ওয়ান ইলেভেন আসবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা কি রয়েছে? অথবা সরকার পতনের পর যারা আজ শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশি সৈন্য প্রেরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তারাই কি ক্ষমতার বসবেন?
দ্বিতীয়ত: যদি সরকার পতনের আগে শান্তিরক্ষা বাহিনী থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়ার ঘোষণা আসেও, তবে কি হবে? বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী কি তখনও বিদ্রোহ করে ক্ষমতার পট পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে? তারা যদি সেটি না করেন? এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কেননা অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার পট পরিবর্তনে যে বাহিনী অগ্রগণ্য সেটি হলো বাংলাদেশ সেনা বাহিনী।
বলা হয়ে থাকে সেনাবাহিনী আগের চেয়ে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত। রাজনৈতিকভাবে তারা আগের মতো ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কাজেই তারা যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাদ পড়লেও তারা নিজ ব্যারাকেই থাকবেন এবং সরকারও তাদের সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন, তবে?
পৃথিবীর সব দেশের সৈন্যরা কি শান্তিরক্ষা মিশনে যায়? অথবা দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী যদি দেশের স্বার্থে নিজেদের ব্যক্তিগত লাভকে বিসর্জন দিতে রাজি হয়! তবে কি করবেন ষড়যন্ত্রকারীরা?
তৃতীয়ত: যদি মিশনে বাংলাদেশকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয় এবং তৎপরবর্তিতে কোনো অঘটনের মাধ্যমে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়, অর্থাৎ ক্ষমতার পট পরিবর্তনেই যদি সব সমস্যার সমাধান হয়, তবে এর পরে কি লাভ হবে পট পরিবর্তনে ভূমিকা পালনকারী বাহিনীর?
সশস্ত্র বাহিনী কি সরকার পরিবর্তন হলেই তাদের অবস্থান ফিরে পাবেন? তাদের দীর্ঘদিনের পরিশ্রম ও ত্যাগ এবং ১৬৬ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সম্মান ফিরে পাবেন? এক শব্দের উত্তর হলো 'না'।
শান্তি মিশনের দরজা একবার বন্ধ হয়ে গেলে তা আর নাও খুলতে পারে। বিষয়টি এমন নয় যে, সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। বিষয়টি ভালভাবে অনুধাবনের জন্য সাম্প্রতিক একটি ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে আনা যেতে পারে। দক্ষিণ সুদানে শান্তিরক্ষী মিশন কাজ করছে ২০১১ সাল থেকে। ২০১৬ সালে সরকার ও বিরোধী দল সংঘর্ষে লিপ্ত হলে একদল সরকারি সেনা ইউএন এর এইড ওয়ার্কারদের জন্য নির্ধারিত একটি হোটেল "TERRAIN" আক্রমণ করে। ইউএন এর নিকটবর্তী ক্যাম্প বিষয়টি জানার পরও তড়িৎ উপযুক্ত কার্যক্রম গ্রহণে ব্যর্থ হলে বেশ কয়েকজন মহিলা এইড ওয়ার্কার গণধর্ষণের স্বীকার হয় ও একজন স্থানীয় কর্মচারী নিহত হয়।
বিষয়টি নিয়ে হৈচৈ শুরু হলে ইউএন দক্ষিণ সুদানের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ফোর্স কমান্ডার কেনিয়ার লেঃ জেনারেল জনসন মগোয়া কিমানিকে অব্যাহতি প্রদান করে। কিন্তু কেনিয়া জাতিসংঘের পদক্ষেপে সংক্ষুব্ধ হয়ে হুমকি প্রদান করে যে, তাদের ফোর্স কমান্ডারকে অব্যাহতি দেয়া হলে কেনিয়া দক্ষিণ সুদান থেকে সকল সৈন্য প্রত্যাহার করবে। জাতিসংঘ তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকলে কেনিয়া সুদানে মোতায়েনকৃত পদাতিক কন্টিনজেন্ট প্রত্যাহার করে।
ফলশ্রুতিতে, বাংলাদেশি পদাতিক কন্টিনজেন্ট দক্ষিণ সুদানে শান্তিরক্ষী মিশনে কাজ করার সুযোগ পায়; যা আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। অন্যদিকে, কেনিয়া পরবর্তীতে অনেক চেষ্টা করেও অদ্যাবধি দক্ষিণ সুদানে আর কোন কন্টিনজেন্ট প্রেরণ করতে পারেনি। কাজেই জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সৈন্য প্রেরণের জন্য দরজা বন্ধ হওয়া যত সহজ, খোলা তত সহজ নয়। তাই তাৎক্ষণিক প্রাপ্তির আশায় শান্তিরক্ষী বাহিনী সংশ্লিষ্ট যেকোন হঠকারী সিদ্ধান্ত দেশের ভাবমূর্তি ও সার্বিক বিষয়ের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ একটি ‘ব্র্যান্ড নেম’ শান্তিরক্ষী ও বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট পাঠিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। এটি এখন বাংলাদেশের আয়ের খাত। ‘শান্তি রক্ষা কূটনীতি’ এখন জাতীয় কূটনীতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক শান্তিরক্ষীই বিদেশে বাংলাদেশের শান্তিদূত। ‘পিস কিপিং’ এখন বাংলা সাহিত্যে লেখালেখির নতুন ও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়।
এছাড়া বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা স্বাগতিক দেশের জনগণের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সর্বদা সচেষ্ট। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিদেশের বৈরী পরিবেশে নিজেদের খাপ খাইয়ে প্রদত্ত সব দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে থাকে। আমাদের শান্তি সেনাদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও কাজ, মানবিক গুণাবলি, শৃঙ্খলা এবং স্থানীয় জনগণের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এই সুনামের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে। প্রতিটি সেনা সদস্য সেখানে দেশের একেকজন প্রতিনিধি, শান্তিদূত।
আইভরি কোস্টে স্থানীয় জনগণ তাদের একটি গ্রামের নাম রেখেছে ‘রূপসী বাংলা’। হাইতিতে একটি শিশুর নাম ‘বাংলাদেশ’। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নামে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে, যা শান্তিরক্ষীদের প্রতি দেশগুলোর জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ মৈত্রী স্কুল, বাংলাদেশ সেন্টার। সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি ও প্রাপ্তি হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর সাধারণ মানুষের মুখে ফুটিয়ে তোলা হাসি ও তাদের ভালোবাসা।
এই ভালোবাসা একদিনে অর্জিত হয়নি। এর পেছনে রয়েছে অনেক ত্যাগ ও প্রাণের বিনিময়।১৯৮৮ সালে সেনাবাহিনী, ১৯৮৯ সালে পুলিশ এবং ১৯৯৩ সালে নৌ ও বিমান বাহিনীর যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের গৌরিবময় পদযাত্রা শুরু হবার পর হতে এ পর্যন্ত ১৬৬ জন সৈনিককে প্রাণ উৎস্বর্গ করতে হয়েছে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায়। অথচ নিজ দেশের শান্তি বিনষ্টকারীদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদেই তাদের আত্মত্যাগ আজ বৃথা যেতে বসেছে।
কাজেই বারবার এমন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কবল থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে নিরাপদ রাখতে ভবিষ্যতে যদি তারা পাকিস্তানের মতো 'দেশের রাজনীতি' নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তবে দেশের যে ক্ষতি হবে তার জন্য কারা দায়ী থাকবেন? দেশের মানুষ কি তাদের কখনও ক্ষমা করতে পারবেন? সশস্ত্র বাহিনীও কি তাদের সম্মান ভুলুণ্ঠিতকারীদের ক্ষমা করবে?