আলোচনায় মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্ট

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ০৯:৩২, বুধবার, ২২ মার্চ, ২০২৩, ৮ চৈত্র ১৪২৯

একজন প্রধানমন্ত্রীর যতটুকু ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন ততটুকুই আছে। এটির ডিগ্রি অব অ্যাপ্লিকেশন বা অন্য কিছু নিয়ে একটি বন্ধুরাষ্ট্রের সংশয় প্রকাশ কিংবা প্রশ্ন তোলার নৈতিক অধিকার নেই।

পর্যবেক্ষকদের বিবেচনায় বাংলাদেশে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ২০২২ সালের বৈশ্বিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে। এ ছাড়া বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতন, কারাগারের পরিস্থিতি, ধরপাকড়, আটক বা গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া ও কারাবন্দিদের সঙ্গে আচরণ, বিচারব্যবস্থা, মানবাধিকারকর্মী, নাগরিক সমাজ ও সরকার সমালোচকদের প্রতি হুমকি, হয়রানি, নির্যাতন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার অভাবের বিষয়গুলো প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে গণমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ, শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ ও সংগঠন করার অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, ‘শরণার্থীদের’ সুরক্ষা, মৌলিক সেবাপ্রাপ্তির সুবিধা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের স্বাধীনতা, দুর্নীতি, সরকারি কাজকর্মে স্বচ্ছতার ঘাটতি, বৈষম্য ও সামাজিক নির্যাতন, মানব পাচার, শ্রমিকদের অধিকারসহ নানা বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। গত সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এ  প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর এক প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রকাশিত মানবাধিকার প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম এ প্রতিবেদনে ‘মৌলিক দুর্বলতা’ এবং ‘ভুল’ আছে বলে দাবি করে বলেছেন, বিশ্লেষণ করে দেখা হবে রিপোর্টে আদৌ আমলে নেওয়ার মতো বিষয় আছে কি-না।

প্রতিবেদনটির বিষয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন ও গণতন্ত্রের দুর্বলতা আছে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছেন, মানবাধিকার সমাধান আমাদেরই করতে হবে। বিদেশিরা তাদের স্বার্থে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।


‘২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ অধ্যায়ে বিস্তারিত রিপোর্ট তুলে ধরে। বলা হয়, ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরানো, বিরোধী দলের প্রার্থীদের এজেন্ট এবং ভোটারদের ভয় দেখানোসহ নানা অনিয়মের খবরে পর্যবেক্ষকরা ধারণা পোষণ করেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে ১৯৮টি দেশ ও অঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির কথা রয়েছে; যেখানে অধিকাংশ ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনা ও তার দল পাঁচ বছর মেয়াদে টানা তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকেন।

এতে আরও বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের বিরুদ্ধে বহু নির্যাতনের ঘটনা ঘটানোর অভিযোগ রয়েছে। নির্যাতন ও দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যাপকভাবে দায়মুক্তি দেওয়ার অনেক খবর রয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন বা দুর্নীতিতে জড়িত কর্মকর্তা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চিহ্নিত করা, ঘটনার তদন্ত করা, তাদের বিচার ও সাজা প্রদানে হাতে গোনা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুম, অপহরণের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। এসব অপরাধ প্রতিরোধে, তদন্ত এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে সীমিত প্রচেষ্টা নিয়েছে সরকার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে বলা হয়েছে, ঘন ঘন এই অধিকারে হস্তক্ষেপ করে সরকার।

প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় একটি মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন রিপোর্ট করেছে যে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন ১৬ জন। নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো বলেছে, জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী, অধিকারকর্মী এবং ভিন্ন মতাবলম্বী।

এদিকে এই প্রতিবেদন নিয়ে এক বিবৃতিতে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, ‘মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করার মধ্য দিয়ে দেশ হিসেবে আমাদের পরিচিতির মূল দিকটি ফুটে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র সম্মান, শ্রদ্ধা ও অংশীদারত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিয়মিতভাবে মানবাধিকারের বিষয়গুলো বাংলাদেশ সরকারের কাছে তুলে ধরছে। আমরা এই ধারা আগামীতেও অব্যাহত রাখব।’

আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন ব্যবস্থা ও মানবাধিকার ব্যবস্থায় যে দুর্বলতা আছে সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু মানবাধিকার নিয়ে যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, প্রশ্নটা হচ্ছে এই রিপোর্টের মাধ্যমে বড় বড় দলগুলোর মধ্যে বিভাজন বাড়বে না কমবে। স্বাভাবিকভাবেই বিভাজন আরও বাড়বে। সরকার দল সে যেই হোক না কেন, এক ধরনের উত্তর দেবে। এরাই বিরোধী দলে গেলে আরেক রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে। আবার বিরোধী দলে যারা আছে, তারা খুশি হবে। এই বিরোধী দল যখন আবার ক্ষমতায় ছিল তাদের উত্তর অন্যরকম ছিল। যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিকার অর্থে যে গণতন্ত্র চায়, তাহলে বড় দলগুলোর মধ্যে যে আস্থা বাড়ানো দরকার, এই রিপোর্টের মাধ্যমে সেটি তো হচ্ছে না।

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘তাহলে স্বাভাবিকভাবেই (এখানে) বিভাজন তৈরি হলে তাদেরই স্বার্থ সংরক্ষণ করতে সুবিধা হবে। কারণ সরকারি দল এ রকম রিপোর্টের ব্যাপারে ডিফেনসিভ থাকে। ২০১৮ সালের নির্বাচনটাকে ২০২৩-এ সামনে আনল। হয়তো তারা বলবে, আগামী বছর নির্বাচন, এ জন্য আনা হয়েছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রে, মানবাধিকারের যে ঘাটতি আছে, সেটি কে ঠিক করবে। আমি কখনো মনে করি না যে, বাইরের শক্তি এসে আমাদের যে ঘাটতিগুলো আছে, তারা সেটা ঠিক করতে পারবে। বরং তারা তাদের স্বার্থই উদ্ধার করবে।’ তিনি বলেন, আজ হোক, কাল হোক বাংলাদেশের জনগণকেই নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে হবে।

পর্যালোচনা করবে মানবাধিকার কমিশন : এ দিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রকাশিত মানবাধিকার রিপোর্ট পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘অবশ্যই কারও মানবাধিকার লঙ্ঘন হোক, কারও প্রতি অন্যায় করা হোক, কারও প্রতি নির্যাতন করা হোক সেটা আমরা চাই না। আমরা সব সময় তাই বলে এসেছি।’

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া : মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে ‘মৌলিক দুর্বলতা’ এবং ‘ভুল’ আছে বলে দাবি করেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন বিষয়টি যত দ্রুত সম্ভব যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে তুলে ধরবে বাংলাদেশ। 

মার্কিন প্রতিবেদনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় শাহারিয়ার আলম বলেন, বিশ্লেষণ করে দেখা হবে রিপোর্টে আদৌ আমলে নেওয়ার মতো কোনো বিষয় আছে কি-না? গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম নিজের দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের যে যোগাযোগের মাত্রা, সে প্রেক্ষাপট থেকে আমাদের যে আপত্তিগুলো আছে সামনের দিনগুলোতে উচ্চপর্যায়ের সফর হবে বা অন্য বৈঠকে রিপোর্টের দুর্বলতাগুলো তুলে ধরব, যাতে করে সামনের বছরের রিপোর্টে এগুলো না থাকে। রিপোর্টে মৌলিক কিছু দুর্বলতা কি? তার ব্যাখ্যা দিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, একটি বন্ধুরাষ্ট্র নিয়ে যখন রিপোর্ট তৈরি করা হয় তখন তা প্রকাশ হওয়ার আগে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দেওয়ার কথা। বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি।

শাহরিয়ার আলম বলেন, কোথাও কোথাও আমাদের প্রশংসা করা হয়েছে এবং সে জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। বিশেষ করে বিভিন্ন জায়গায় আমরা উন্নতি করেছি তার প্রতিফলন এই প্রতিবেদনে রয়েছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, একজন প্রধানমন্ত্রীর যতটুকু ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন ততটুকুই আছে। এটির ডিগ্রি অব অ্যাপ্লিকেশন বা অন্য কিছু নিয়ে একটি বন্ধুরাষ্ট্রের সংশয় প্রকাশ কিংবা প্রশ্ন তোলার নৈতিক অধিকার নেই।

বিষয়ঃ বাংলাদেশ

Share This Article