শতকোটি টাকার প্রকল্পে আড়াই বছরে কাজ ৩.৫%

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:১৮, মঙ্গলবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১, ১৩ পৌষ ১৪২৮
৮৮০ কোটি টাকার প্রকল্পে আড়াই বছরে কাজ ৩.৫%
৮৮০ কোটি টাকার প্রকল্পে আড়াই বছরে কাজ ৩.৫%

নিজস্ব প্রতিনিধি: শানশওকত সব আছে। টিফিন ভাতা, চিকিৎসা খরচ, আপ্যায়ন বিল, উৎসব ভাতায়ও খরচ হচ্ছে প্রকল্পের টাকা। রয়েছে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী। পাঁচটি প্রাইভেটকার, দুটি মাইক্রোবাস ভাড়ায় নিয়ে ব্যবহার করছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। তবে এতসব আয়োজন ডিএসসিসির যে প্রকল্পকে কেন্দ্র করে, সেই প্রকল্পে কাজের অগ্রগতি নেই। আড়াই বছর শেষে কাজের অগ্রগতি মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ। 

 

যদিও নানা কাজে এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ২৮ কোটি টাকা। প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার কারণে এ প্রকল্প আদৌ বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা তা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন অনেক প্রকৌশলী। কারণ কাজের অগ্রগতি সাড়ে ৩ শতাংশ দেখানো হলেও তা বেশিরভাগই কনসালটেন্সি এবং শানশওকত বাবদ খরচের হিসাব। মাঠ পর্যায়ে কেবল একটি কাজই চলমান। জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকার অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর, খিলগাঁও, লালবাগ ও সূত্রাপুর এলাকার উন্নয়নে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।

‘ঢাকা সিটি নেইবারহুড আপগ্রেডিং প্রজেক্ট’ নামের সেই প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০১৯ সালের ১ মার্চ অনুমোদন দেয়। যেখানে মোট ৮৮০ কোটি টাকা ব্যয়ের ৮৩৪ কোটিই ঋণ হিসেবে দেবে বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালের জুনে। ২০২৪ সালে এর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাগজ-কলমের হিসাবে প্রকল্পের অগ্রগতি কেবল ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। সেটিও আবার স্থানীয়দের জন্য যেন ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া। 

কাজের আওতায় খেলার মাঠ, পার্ক ও পথচারী সেতুসহ বিভিন্ন অবকাঠোমা নির্মাণের কথা বলা হলেও অগ্রগতি বলতে পুরান ঢাকার রাজ নারায়ণ ধর রোডের উন্নয়নকাজ চলমান। তবে কাজের কাজ কিছু না হলেও দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতনের সঙ্গে ভাতা নিয়েছেন পাই পাই হিসাব করেই। সব মিলিয়ে ইতোমধ্যে প্রকল্পের খরচ দেখানো হয়েছে ২৮ কোটি টাকা।

প্রকল্পের আওতায় ঢাকার পিছিয়ে থাকা ওই চার এলাকায় তিনটি খেলার মাঠ, আটটি শৌচাগার, ৯টি বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র এবং পথচারী ও যানচলাচলের জন্য দুটি করে সেতু নির্মাণের কথা। এ ছাড়া ২০টি পার্কের উন্নয়ন, বুড়িগঙ্গা নদীর প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার তীর উন্নয়ন, চার কিলোমিটার সরু রাস্তা, ৩৯ কিলোমিটার নর্দমার উন্নয়নসহ নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছিল।

করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৯ সালে অনেকটা তাড়াহুড়া করেই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল। ফলে উন্নয়ন কাজের যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা ছিল মূলত অনুমানের ভিত্তিতে। উন্নয়ন কাজ কোথায় হবে, ব্যয় কত হবে, এসব নিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষকে দিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করা (সমীক্ষা) হয়নি। তাই মাঠপর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। যেমন তিনটি মাঠ তৈরির কথা বলা হলেও সেগুলো কোথায় হবে, জমি অধিগ্রহণ করা লাগবে কিনা, তাতে কত ব্যয় হবে- এসব নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই নেই। এমন পরিস্থিতিতে পুরো পরিকল্পনায় বড় ধরনের পরিবর্তন ছাড়া তা বাস্তবায়নের উপায় নেই। কর্মকর্তারা আরও বলছেন, বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রকল্পটি নিয়ে নতুনভাবে কাজ শুরু হয়। তবে মেয়রের তাগাদায় কিছু দিন কাজের ক্ষেত্রে উদ্যমী থাকলেও বর্তমানে আবারও চলছে ঢিলেঢালাভাবে।

পুরো প্রকল্পের মূল কাজের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কেবল একটি কাজের আংশিক শেষ করতে পেরেছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। পুরান ঢাকার শহীদনগর এলাকার কাজী রিয়াজউদ্দিন রোড এবং রাজ নারায়ণ ধর রোড এলাকার রাস্তাটি আংশিক সমাপ্ত হয়েছে। প্রায় এক বছর ধরে রাস্তাটি খুঁড়ে রাখার পর সম্প্রতি এর কাজ শেষ করা হয়েছে। গতকাল ওই এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে এখনো কাজী রিয়াজউদ্দিন রোডের প্রবেশ মুখে বাঁশ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। নির্মাণকাজ চলমান থাকায় ওই এলাকা দিয়ে কোনো পরিবহন ঢুকতে পারে না। একই অবস্থা রাজ নারায়ণ ধর রোডেও। ওই রোডের কাজ আংশিক শেষ হলেও এখনো বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দ রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন পরিস্থিতিকে ‘মডারেটলি আনস্যাটিসফ্যাক্টরি’ (মাঝারি মাত্রায় অসন্তোষজনক) উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিমাসেই সিটি করপোরেশনের চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়। ঢাকা সিটি নেইবারহুড আপগ্রেডিং প্রজেক্টের গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত অগগ্রতি হিসাবে দেখা গেছে, কাগজে-কলমে অগ্রগতি দেখানো হয়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ। এ পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৩.৭১ শতাংশ। প্রকল্পের অগ্রগতির হিসাবে দেখা যায়, পিপি লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে ৫টি প্রাইভেটকার ভাড়া বাবদ খরচ ৩ কোটি ৮৪ লাখ এবং ২টি মাইক্রোবাস ভাড়া বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে গত অর্থবছরের শেষের দিকে এসব গাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়। যদিও করপোরেশনসংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, যেসব গাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে তা পুরনো মডেলের, ভাঙাচোরা। যে টাকায় এসব গাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে তা দিয়ে অনায়াসেই এসব গাড়ি থেকেও উন্নতমানের গাড়ি কিনে নেওয়া যেত। এর বাইরে গাড়ির ব্যবহার নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।

করপোরেশনের প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, সাধারণত নিয়ম অনুসারে এ ধরনের প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। প্রকল্পটির পরিচালক হিসেবে রয়েছেন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম। তিনি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী আগেই একটা গাড়ি ব্যবহার করেন। সে ক্ষেত্রে নতুন এ প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার করার সুযোগ নেই। এর পরও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে ৭টি গাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ে কাজ না থাকলেও এসব গাড়ি কী কাজে ব্যবহার করা হয় অনেক চেষ্টা করেও তা জানা সম্ভব হয়নি। কেবল তাই নয় সিরাজুল ইসলাম মূলত একজন স্থপতি হিসেবে নগরভবনে চাকরিতে প্রবেশ করেন। নথি ঘেঁটে দেখা গেছে ২০০৪ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনে যখন প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ পদটি ফাঁকা হয়, ওই সময় অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তাকে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পর থেকে তিনি প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবেই কাজ করছেন। এর পর ঢাকা সিটি ভাগ হলে তিনি দায়িত্ব পালন শুরু করেন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। সেখানেও তিনি প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ পদবি ব্যবহার শুরু করেন। যদিও প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সংক্রান্ত স্থায়ী নিয়োগের নথি নেই দক্ষিণ করপোরেশনের কাছে।

প্রকল্পের পরিচালক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। গত ২১ ডিসেম্বর এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ফোন করলে তিনি ‘প্লিজ টেক্সট মি’ লিখে খুদেবার্তা পাঠান। পরে ফিরতি বার্তায় তাকে জানানো হয় ঢাকা সিটি নেইবারহুড আপগ্রেডিং প্রজেক্ট সম্পর্কিত বিষয়ের জন্য কথা বলতে চাচ্ছি। এর পর পাঁচ দিন তিনি ফোন বা খুদে বার্তার জবাব দেননি। সবশেষ গত রাতে তাকে ফোন করা হলে তিনি কলটি রিসিভ করেন। এ সময় তিনি বলেন, তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে এ বিষয়ে উত্তর দেবেন।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ঢাকা সিটি নেইবারহুড আপগ্রেডিং প্রজেক্ট বিশ্বব্যাংকের একটি ফ্রেম ওয়ার্ক প্রকল্প। এ ধরনের প্রকল্পে প্রথম এক বা দেড় বছর ফিজিবিলিটি, এনভারয়নমেন্ট এবং সোশ্যাল স্টাডি করতে হয়। বর্তমানে প্রকল্পটি নিয়ে মেয়র শক্ত ভূমিকা পালন করছেন।

তবে ইতোমধ্যে প্রকল্প শুরুর আড়াই বছরের বেশি সময় পার হয়েছে এমন তথ্য জানালে তিনি বলেন, আমরা আরও দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে চাই। তবে বিশ^ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করতে অনেক কনসালট্যান্ট এবং স্টাডি দরকার হয়। যেগুলোতে অনেক সময় লাগে।

Share This Article