রূপান্তরে বাংলাদেশ উত্তরণে বাংলাদেশ

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ০৯:৫৩, বুধবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২১, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪২৮
রূপান্তরে বাংলাদেশ উত্তরণে বাংলাদেশ
রূপান্তরে বাংলাদেশ উত্তরণে বাংলাদেশ

জাকির হোসেন

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি হানাদার শত্রুর কবলমুক্ত হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর নতুন গুরুত্ব নিয়ে এসেছে। বিজয়ের ৫০ বছর আলোকিত হয়ে উঠেছে উন্নয়ন ও অগ্রগতির আন্তর্জাতিক এক বিশেষ স্বীকৃতির কারণে। 

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরেই গত ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের নির্দিষ্ট কমিটি স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি শ্রেণি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করে। আর গত ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ তা অনুমোদন করেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে।

 

গত ১০ বছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে ৬ শতাংশের বেশি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে তা ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। করোনা মহামারির মধ্যেও গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। করোনার আগে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সময়কালে বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে গড়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ভারতে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। মালয়েশিয়ায় এ সময়কালে প্রবৃদ্ধি হয় ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে। দেশটি এখন হানাহানি আর পশ্চাদ্‌গামিতার উদাহরণ। আর বাংলাদেশের পরিচিতি উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে।

১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৮৮ ডলার, যা ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। সর্বশেষ হিসাবে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৫৫৪ ডলার। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এখন ৪০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৩৪ লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকা।

উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতির ভিত্তি রচনা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর ঘোষণা করেন, মাটি ও মানুষকে কাজে লাগিয়ে তিনি এ দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করবেন। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও তাদের জীবনমানের উন্নতির জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। আজ তার সংগ্রামের সুফল ভোগ করছে জাতি। তার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার এ পথে অনেক অর্জন করেছে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যাপক সামাজিক অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশে গত ৩০ বছরে গড় আয়ু বেড়েছে ১৫ বছর। আর পাকিস্তানে বেড়েছে সাত বছর। সে দেশের গড় আয়ু এখন ৬৭ বছর। বাংলাদেশের গড় আয়ু ৭৩ বছর। ভারতে গড় আয়ু ৬৯ বছর। ২০২০ সালে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রতি হাজারে ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১৯৯০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৪৪ জন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তির হারের ক্ষেত্রেও অনেক উন্নতি হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের বয়স বিবেচনায় শিশুদের ৭৩ ভাগ এখন স্কুলে যায়।

দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে প্রশংসিত হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশে দরিদ্র লোকের হার ছিল ৮২ শতাংশ। সর্বশেষ প্রকাশিত খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এর ভিত্তিতে ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের প্রাক্কলিত হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। কভিডের কারণে গত বছর দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হয়। সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপ বলছে, এর অনেকটাই এখন পুনরুদ্ধার হয়েছে।

বাংলাদেশের পরবর্তী পর্যায়ের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি কী হতে পারে, তা নিয়ে সম্প্রতি গবেষণা করেছেন বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সাবেক সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ও বর্তমানে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ। সমকালকে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর মাত্র পাঁচ দশকের মধ্যেই মধ্যম আয়ের দেশে বাংলাদেশের রূপান্তর ঘটেছে, যা উন্নয়ন সাফল্যের একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশের বেসরকারি খাত এ অগ্রগতিতে মূল ভূমিকা পালন করেছে। উৎপাদন খাত প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৮১ সালে জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন খাতের অবদান ছিল ১৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। এই সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ ২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

তিনি মনে করেন, তৈরি পোশাকের মতো প্রতিষ্ঠিত খাত উন্নয়নে অবদান রাখবে। তবে আগামী দিনের উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য নতুন চালিকাশক্তির দরকার হবে। তারা গবেষণা করে দেখেছেন, কৃষি-বাণিজ্য, ডিজিটাল অর্থনীতি ও সবুজ অর্থায়ন হতে পারে আগামী দিনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তিনটি প্রধান চালিকাশক্তি।

কাঠামোগত রূপান্তর :বাংলাদেশ ছিল কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিপ্রধান থেকে শিল্প ও সেবাপ্রধান অর্থনীতিতে রূপান্তর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আধুনিকায়ন এনেছে। ১৯৭৫-৭৬ সালে বাংলাদেশ মাত্র ৩৮০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। এখন বছরে রপ্তানি হয় ৩৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। তৈরি পোশাক খাত এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির রূপান্তরে মূল ভূমিকা পালন করেছে।

দেশ স্বাধীনের পর প্রথম অগ্রাধিকার ছিল কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার ছিল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। আশির দশকে তৈরি পোশাক খাতে উদ্যোক্তা শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। সরকারের প্রণোদনার সহায়তায় উদ্যমী উদ্যোক্তারা দেশকে শিল্প উৎপাদনমুখী অর্থনীতির দিকে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা পালন করেন। পোশাকের পাশাপাশি আরও কিছু খাতে অগ্রগতি হয়।

বাণিজ্যিক কৃষি ও শিল্পের প্রসারের কারণে সেবা খাতের প্রসার ঘটে। আর নব্বইয়ের দশকে এসে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে নেওয়া নানা কর্মসূচি বাংলাদেশকে সামাজিক অগ্রগতিতে অনেকটা এগিয়ে নেয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রগতি বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার আরেকটি বিষয়। স্বাধীনতার পর ২০০৯ সাল পর্যন্ত চার দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। গত ১০ বছরে তা ২০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে।

বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সাফল্য দেখিয়েছে। নিজেদের টাকায় নির্মিত পদ্মা সেতু এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। ঢাকায় মেট্রোরেলের নির্মাণও দৃশ্যমান পর্যায়ে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজ চলছে। সম্প্রতি পায়রা সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে, যা দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। আরও কয়েকটি বড় অবকাঠামো প্রকল্পের কাজ চলছে। দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি অঞ্চলে উৎপাদন শুরু হয়েছে।

উত্তরণে বাংলাদেশ :বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের শ্রেণীকরণে ২০১৫ সালের ১ জুলাই নিম্ন আয় থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে ধারাবাহিক উন্নতির কারণে বাংলাদেশ এ তালিকায় আসে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত বা এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য বলে স্বীকৃতি দেয়। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ওই কমিটি বাংলাদেশকে উত্তরণের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ করে।

মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সামাজিক সূচকে উন্নতি এবং অর্থনীতির টিকে থাকার সক্ষমতার বিচারে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য মনে করছে জাতিসংঘ। ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে ভারত, চীন, মালয়েশিয়ার মতো এলডিসি নয় এমন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে বাংলাদেশ।

গত বছর বিখ্যাত সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট ৬৬টি সবল অর্থনীতির তালিকা প্রকাশ করে, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল নবম। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য-এমডিজির অনেক সূচক অর্জন করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়ে বাংলাদেশ। এমডিজিতে ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি হারে কমাতে সক্ষম হয়। এমডিজি অর্জনে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ। এসডিজি অর্জনের কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লক্ষণীয় অগ্রগতি রয়েছে।

আগামীর চ্যালেঞ্জ :অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, উন্নয়নের নতুন স্তরে পৌঁছে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে যা মোকাবিলা করতে হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের জন্য বাণিজ্যে অগ্রাধিকার সুবিধা অনেক কমে যাবে।

এ কারণে আগামী পাঁচ বছরের উত্তরণকালীন প্রস্তুতি বাংলাদেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই উত্তরণে এসডিজি, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করে উত্তরণের শক্তিশালী কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। সার্বিকভাবে আগামী দিনের অগ্রগতির জন্য স্থানীয় বাজার এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, কর্মসংস্থান বাড়ানো, অবকাঠামো উন্নয়ন, দুর্নীতি কমানো, মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রসারসহ অনেক বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়ার সুপারিশ উঠে আসছে বিভিন্ন আলোচনায়।

বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরবর্তী পর্যায়ে যেতে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। প্রতিবছর ২২ লাখ মানুষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। তাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করা আগামী দিনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

সমকাল

Share This Article


‘স্বনির্ভর দেশ গড়তে প্রাণিসম্পদের উৎপাদন বাড়াতে হবে’

এক বন্ধুকে খুশি করতে অন্যের বিরাগভাজন হতে পারি না: সেনাপ্রধান

ঢাকায় ভিসা সেন্টার খুলল চীন

দুঃসংবাদ দিল আবহাওয়া অফিস

থাইল্যান্ড সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় স্থান, কে এই বাংলাদেশি নারী?

টাইমের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় বাংলাদেশের মেরিনা

তৃতীয় ধাপে যেসব উপজেলায় ভোট অনুষ্ঠিত হবে

তীব্র গরমে হাসপাতালে বাড়ছে শিশু রোগী

এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিকের ভয়ঙ্কর ৩২ দিন!

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রভাব মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

২১ নাবিক ফিরবেন জাহাজে, দুজন বিমানে