যেভাবে ঢাকার বিকল্প হতে পারে মোংলা!

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ বিকাল ০৫:০৭, রবিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ৪ পৌষ ১৪২৮
ফাইল ফটো
ফাইল ফটো

আন্তর্জাতিকভাবে শেখ হাসিনা সরকার জলবায়ু অভিযোজনের পেছনে নানা পদক্ষেপ নিতে যত বিপুল পরিমাণ অর্থই ব্যয় করুক না কেন, আলীর মতো রাজনীতিবিদদের পক্ষে কিন্তু সেই তহবিলের নাগাল পাওয়া খুবই কষ্টকর ব্যাপার।

 

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে, গাবুরা থেকে ২৫ মাইল উত্তর-পূর্বে মোংলার অবস্থান। সীমান্তবর্তী শহরের আমেজ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। একটি নদী এসে দ্বিখণ্ডিত করেছে শহরটিকে। কাঠের নড়বড়ে নৌকায় চেপে পার হওয়া যায় সেই নদী। পকেট থেকে খসে মাত্র তিন টাকা।

সূর্যের গনগনে উত্তাপ মাথায় নিয়ে একদিন আমিও পার হলাম সেই নদী। তারপর চড়ে বসলাম একটি রিকশায়। যে কয় মিনিট সেটি চলল, মেরুদণ্ডের অবস্থা প্রায় নাজেহাল হয়ে গেল। অবশেষে সেটি এসে থামল মেয়র মোহাম্মদ জুলফিকার আলীর অফিসের সামনে।

ঘটনাক্রমে সেদিন আবার মেয়রের জন্মদিন। তার ডেস্কের উপর জমেছে ফুলের পাহাড়। পাশে আবার পড়ে রয়েছে শুভাকাঙ্ক্ষীদের রেখে যাওয়া চালের পিঠা। এদিকে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, মেয়রের দেয়ালের পেছনে ঝোলানো রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পিতা, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করায় নেতৃত্ব দেওয়া শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি।

খেয়াল করে দেখলাম, প্রধানমন্ত্রীর ছবিটি কিন্তু দুর্দান্ত অবস্থায় রয়েছে। এ কথা বলছি এজন্য যে, মেয়র আলীর বিরুদ্ধে রয়েছে ছবি ধ্বংসের এক অদ্ভুত অভিযোগ, যার সুবাদে তাকে আদালতে পর্যন্ত দৌড়াতে হয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে যে অজস্র রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে অপরাধ মামলা হয়েছে, মেয়র আলীও তাদের একজন।

সুজানা স্যাভেজ নামের এক ঢাকা-ভিত্তিক তরুণ সাংবাদিক ফিনানশিয়াল টাইমসের হয়ে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন কভার করেছেন। নির্বাচনের ফলাফলের পেছনে ব্যাপক জালিয়াতি ও ভোটারদের ভীতি-প্রদর্শনের সংবাদ প্রকাশ করা সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম সুজানা, তাই তিনি শেখ হাসিনা সরকারের রোষের শিকার হয়েছেন।

সুজানা আমাকে বলেছেন, তাকে বাংলাদেশি গোয়েন্দারা আটক করে এবং হ্যান্ডকাফ পরিয়ে যুক্তরাজ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বন্দি অবস্থায় তাকে নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে মাথায় প্রচণ্ড আঘাতও। এই লেখাটি যখন লিখছি, তিনি লন্ডনে বসে ব্রেইন সার্জারির অপেক্ষা করছেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ ক্রমশই বাড়ছে। সুজানার ঘটনাটিও সেসব অভিযোগেরই একটি।

তবে সে যা-ই হোক, গোটা দুনিয়ার কাছে কিন্তু আপাত মমতাময়ী শেখ হাসিনা পরিচিত এমন একজন নেত্রী হিসেবে, যিনি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের এ লড়াইয়ে তিনি আত্মবিশ্বাসী ভূমিকা পালন করছেন, বৈশ্বিক সম্মেলনগুলোতে উদ্দীপ্ত আহ্বান জানাচ্ছেন এবং আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রের মতামত কলামও মাতিয়ে রাখছেন।

ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম নামের যে সংগঠনটি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা ৪৮টি উন্নয়নশীল দেশের হয়ে কাজ করছে, সেটির চেয়ার হিসেবে হাসিনা বর্তমানে দ্বিতীয় মেয়াদে রয়েছেন। এ কাজ করার সুবাদে নিউইয়র্কে 'ইউএন চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ' পুরস্কারও জিতেছেন তিনি।

তবে আন্তর্জাতিকভাবে শেখ হাসিনা সরকার জলবায়ু অভিযোজনের পেছনে নানা পদক্ষেপ নিতে যত বিপুল পরিমাণ অর্থই ব্যয় করুক না কেন, আলীর মতো রাজনীতিবিদদের পক্ষে কিন্তু সেই তহবিলের নাগাল পাওয়া খুবই কষ্টকর ব্যাপার। অন্তত তেমনটিই দাবি করছেন মেয়র আলী নিজে।

তারপরও বর্তমানে শেখ হাসিনার পরিবেশ উপমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা এক স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের আইনপ্রণেতার সাহায্যে আলী আদর্শ মোংলা বিনির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। তিনি চাইছেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের জন্য জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক ঘরবাড়ির সমন্বয়ে একটি আধুনিক শহর গড়ে তোলার। যদি তার এই স্বপ্ন পূরণ হয়, তাহলে সুদূরবর্তী রাজধানীতে গিয়ে জীবন নিয়ে বড় ধরনের বাজি খেলার চেয়ে, নিজেদের জন্মশহরেই এক নতুন জীবনের স্বাদ পাবে ওই হাজারো মানুষ।

"যখন আমি ক্ষমতায় এলাম, তখনও বাচ্চারা রাস্তায় মাছ ধরে বেড়ায়," বললেন মৃদুভাষী আলী, যিনি ২০১১ সাল থেকে মোংলার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঘূর্ণিঝড়ের ঢেউ থেকে হওয়া বন্যা মোকাবেলায় তিনি জাতীয় সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন বিদেশি সংস্থাগুলোর থেকে ২০০ মিলিয়ন ডলার উত্তোলনে, যা দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে একটি সাত মাইল লম্বা বাঁধ। তাছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় ওই এলাকা দিয়ে আড়াআড়িভাবে যাওয়া খালগুলোতেও স্লুইস গেট বসানো হয়েছে, যেন উচ্চ স্রোতের ফলে নোনা পানির প্রবেশ আটকানো যায়।

এভাবেই শহরের প্রতিরক্ষাকে মজবুত করার পাশাপাশি আলী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকেও পাখির চোখ করেছেন। আর তার সেই প্রচেষ্টাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের উপর প্রভাব বিস্তারে আগ্রহী দুই প্রতিবেশী পরাশক্তির লড়াই। ৫৫০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে মোংলা বন্দর সম্প্রসারণের যে কাজ চলছে, সেখানে প্রায় অর্ধেক অর্থই ঢালছে চীন। এদিকে শহরের দক্ষিণ অঞ্চলের ১০০ একরেরও বেশি জায়গাকে রূপান্তর করা হচ্ছে পুরোপুরি ভারতীয় শিল্প অঞ্চল হিসেবে। সেখানে কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাত থেকে শুরু করে রাসায়নিক উৎপাদন, সব ধরনের কার্যক্রমই চলবে।

এই মুহূর্তে মোংলা শহরের জনসংখ্যা ৪০,০০০। যেহেতু শহরের অর্থনীতির ক্রমোন্নতি ঘটছে, এবং গ্রামাঞ্চলের সমস্যাও বাড়ছে বৈ কমছে না, তাই আলী আশা করছেন শীঘ্রই শহরের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তবে মোংলার অবস্থা যেন রাজধানী ঢাকার মতো হয়ে না যায়, তা নিশ্চিত করতে আলী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

প্রথম শহর হিসেবে দেশের শীর্ষ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আইসিসিসিএডি-র একটি উদ্যোগে অংশ নিচ্ছে মোংলা। এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো দেশজুড়ে ২০টি শহরকে অভিবাসন বৃদ্ধিজনিত সংকট মোকাবেলায় প্রস্তুত করে তোলা। যদিও গ্রামাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষের চিরাচরিত জীবন রক্ষার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে, তারপরও এই স্কিমের প্রকৌশলীরা এই যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, অভিবাসনে বাধ্য হওয়া মানুষদের সামনে যেন ঢাকার বস্তিতে মাথা গোঁজার কিছু বিকল্প অন্তত থাকে।

আইসিসিসিএডি-র সঙ্গে জুটি বেঁধে আলী তার শহরের সম্ভাব্য নতুন বাসিন্দাদের জন্য পরিকল্পনা তৈরি করছেন। সেই পরিকল্পনায় প্রাধান্য পাচ্ছে নিরাপদ, সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন, যেখানে স্যানিটেশন ও পরিষ্কার পানি তো সহজলভ্য হবেই, সেই সঙ্গে থাকবে ঘূর্ণিঝড়ের কথা মাথায় রেখে স্টর্ম শেল্টার। শেষোক্ত বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি, কেননা সমুদ্রের উষ্ণতা ও পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়গুলো আরও বেশি প্রলয়ঙ্করী হয়ে উঠবে।

বিকেলে মেয়র সাহেব আমাকে তার সেই মহামূল্যবান বাঁধ দেখাতে নিয়ে গেলেন। তখন তার পাশে পাশে ছাতা হাতে ছিল এক সহচর। বাঁধটি সুসজ্জিত, আর সেখানে রয়েছে লিকলিকে, কমবয়সী গাছের সারি। এগুলো দেখলে সিউলের মতো আধুনিক এশীয় শহরের কথাও মনে পড়ে যেতে পারে। যদিও আপনাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনার জন্য রয়েছে আশপাশের বাড়িঘর থেকে 'উড়ে এসে জুড়ে বসা' হাঁস ও ছাগলের দল।

বাঁধ থেকে সব ধরনের পশুকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, জানালেন মেয়র আলী। "তবে এ কথা মানুষজনকে বারবার মনে করিয়ে দিতে হয় আমাদের, যতক্ষণ না তারা সে কথা মানে।"

কিন্তু আমরা যখন নতুন বসানো স্লুইস গেটগুলোর কাছে পৌঁছালাম, মেয়রের মুখে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। উচ্চ স্রোত থেকে নোনা পানির প্রবেশ আটকানোর বদলে গেটগুলোকে খুলে দেওয়া হয়েছে। আগেও আমি অসংখ্যবার পড়েছি ও শুনেছি চিংড়ি চাষীদের প্রসঙ্গে, যারা অনৈতিকভাবে এ অঞ্চলের নোনা পানির সংকট মোকাবেলার প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করছে। এবার স্বচক্ষে দেখলাম সেই কাজের দৃষ্টান্ত।

একটি বাচ্চা ছেলে স্লুইস গেটের অপর প্রান্ত থেকে তাকাল। এদিকে মেয়রের মুখে অনর্গল ধমক শুনে এক অসহায় ওভারসিয়ার (পরিদর্শক) গেটের দড়ির বাঁধন খুলতে শুরু করল। মেয়র আলী তখনও রাগে গজরাচ্ছেন।

অনুবাদ: জান্নাতুল নাঈম পিয়াল 
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

Share This Article