বিজয় দিবস পালনে ইসলামের ভাবনা

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ বিকাল ০৪:০৮, বৃহস্পতিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১, ১ পৌষ ১৪২৮
বিজয় দিবস পালনে ইসলামের ভাবনা
বিজয় দিবস পালনে ইসলামের ভাবনা

মাহমুদ আহমদ

আজ ১৬ ডিসেম্বর। আমাদের বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হচ্ছে। ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বন্যায় এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন এই বাংলাদেশ।

 

ইসলামে বিজয় ও স্বাধীনতার গুরুত্ব অপরিসীম। সৃষ্টির প্রতিটি জীব স্বাধীনতা পছন্দ করে। পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি বা জীব পাওয়া যাবে না যারা পরাধীন থাকতে চায়।

তাই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সবারই কতই না চেষ্টা-প্রচেষ্টা করে থাকে। আর এই স্বাধীনতার জন্যই মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে মক্কাকে করেছিলেন স্বাধীন। সকলকে উপভোগ করতে দিয়েছিলেন বিজয়ের প্রকৃত আনন্দ। বিজয় দিবস সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের দু’টি সুরা আমাদের সামনে পড়ে। একটি সুরাতুল ‘ফাতাহ’ (বিজয়), আরেকটি সুরার নাম ‘আন-নাসর’ (মুক্তি ও সাহায্য)। আসলে বিজয়ের যে আনন্দ প্রকাশ তা আল্লাহর শুকরিয়া, আল্লাহর পবিত্রতা ও বড়ত্ব বর্ণনা করার মাধ্যমেই ইসলাম আমাদেরকে দেয়।

ইসলামের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত নবীর আগমন হয়েছে তারা সবাই সমাজ, দেশ ও জাতির স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন। আর এই স্বাধীনতা অত্যাচারী শাসকের দাসত্ব থেকে জাতিকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রেই হোক বা ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে হোক। এক কথায় বলা যায়, সব ধরনের দাসত্ব ও পরাধীনতা থেকে মুক্ত করাই হচ্ছে আল্লাহতায়ালার প্রেরিত নবীদের কাজ। 
আমরা জানি, গোলাম মুক্ত করে এবং সর্বক্ষেত্রে স্বাধীনতার জন্য যিনি আজীবন লড়াই করে গেছেন এবং শতভাগ সফল হয়েছেন তিনি হলেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি হচ্ছেন স্বাধীনতার উজ্জ্বল সূর্য। যার কিরণ দূর-দূরান্তে বিস্তার লাভ করেছে, যিনি নিজের মাঝে সব ধরনের স্বাধীনতাকে ধারণ করেছিলেন। যিনি মানুষকে শুধু বাহ্যিক দাসত্ব থেকেই স্বাধীনতা দেননি, বরং সমাজ ও দেশ থেকে সব ধরনের নৈরাজ্য দূর করে সবাইকে করেছিলেন স্বাধীন।

বিশ্বের এক বিশাল জনগোষ্ঠী অবলোকন করেছে, কিভাবে বিশ্বনবী (সা.) সর্বত্রে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরাধীনতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য তিনি যেমন লড়েছেন তেমনি তিনি সকলকে করেছিলেনও স্বাধীন। কিন্তু এটি বড়ই পরিতাপের বিষয়, অনেক জাতি স্বাধীনতার প্রকৃত পতাকাবাহীদের অস্বীকার করে এবং সর্বোত্তম শাসকের (আল্লাহর) শাসনের ওপর জাগতিক শাসকের দাসত্বকে অগ্রাধিকার প্রদান করার ফলে তারা কেবল নিজেরাই প্রকৃত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়নি বরং বহু জাতি আল্লাহর আজাবগ্রস্ত হয়ে ধ্বংসও হয়েগেছে। একান্তই সত্য যে, বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাওয়ার কারণে স্বাধীনতা কেবল তাদের হাতছাড়া হয়নি বরং সে জাতির ইহ ও পরকাল উভয়ই ধ্বংস হয়ে গেছে।

স্বাধীনতাকে ইসলাম যেমন গুরুত্ব দিয়েছে তেমনি দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধকেও অতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং একে ঈমানের অংশ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহানবী (সা.)-এর হৃদয়ে স্বদেশ প্রেম যেমন ছিল তেমনি তার সাহাবায়ে কেরামদের মাঝেও বিদ্যমান ছিল। তিনি (সা.) মক্কা থেকে মদীনার পথে হিজরতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার পূর্বে তার মুখ ফেরালেন জন্মভূমি মক্কার দিকে, যেখানে তিনি নবুয়ত লাভ করেছেন এবং তার পূর্বপুরুষরা বসবাস করে আসছেন। তিনি বার বার ফিরে তাকাচ্ছেন মক্কার দিকে, চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে।

মক্কার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন ‘হে মক্কা! তুমি আমার কাছে সমস্ত স্থান থেকে অধিক প্রিয়, আমি মক্কাকেই ভালোবাসি। আমার মন মানছে না। কিন্তু তোমার লোকেরা আমাকে এখানে থাকতে দিল না, সব কিছুর মালিক তুমি। মক্কার মানুষদের ঈমানের আলোয় উজ্জল কর। ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত কর’ (মুসনাদ আহমদ ও তিরমিযি)।

একটু ভেবে দেখুন! স্বদেশের প্রতি কতই না গভীর প্রেম ছিল তার। যে দেশের লোকেরা তার ওপর এত জুলুম অত্যাচার করেছে তারপরও মাতৃভূমির প্রতি কত অগাধ ভালোবাসা। একে বলে স্বদেশপ্রেম। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌম রক্ষায় হজরত রসূল করিম (সা.) যখনই আহ্বান করেছেন তখনই সাহাবায়ে কেরাম (রা.) সর্বোতভাবে এ ডাকে সাড়া দিয়েছেন। তারা জানতেন, নিজেদের বিশ্বাস, আদর্শ ও দ্বীন ধর্মমত প্রতিষ্ঠার জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের প্রয়োজন।

ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যেমন আন্তরিক ছিলেন, তেমনি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন দেশপ্রেম ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায়। মাতৃভূমির প্রতি রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসার বহি:প্রকাশ দেখুন। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমি খায়বর অভিযানে খাদেম হিসেবে রসূল (সা.)-এর সাথে গেলাম। অভিযান শেষে রাসুল (সা.) যখন ফিরে এলেন, উহুদ পাহাড় তার দৃষ্টিগোচর হলো। তখন মহানবী (সা.) বললেন, এই পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও একে ভালোবাসি’ (বোখারি)।

প্রিয় নবী (সা.) মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিজয়ের চেতনাকে জাগ্রত করে, তাদেরকে মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয়, সম্মান, আত্মমর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠা করে দুনিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তিনি যেমন অসংখ্য দাসকে নিজ খরচে মুক্ত করেছেন তেমনি সমগ্র বিশ্বকে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ।

নিজ দেশের প্রতি, দেশের সম্পদের প্রতি আমাদের অনেক বেশি ভালোবাসা সৃষ্টি করতে হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে সেই তৌফিক দান করুন, আমিন।


লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
[email protected]

Share This Article