১৫০কোটি টাকার ব্যবসাসহ বিদেশেও হাঁড়িভাঙা আম রপ্তানির হাতছানি

নিজস্ব প্রতিনিধি: আগামী মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বাজারে পাওয়া যাবে রংপুরের জনপ্রিয় ও সুস্বাদু আম হাঁড়িভাঙা। সারাদেশে জনপ্রিয়তার তালিকায় থাকা এই আম ১৫ জুন গাছ থেকে পাড়া শুরু হবে। তবে প্রচণ্ড গরম থাকলে দু-একদিন আগেও বাণিজ্যিকভাবে বাজারে হাঁড়িভাঙা আম বিক্রি করতে পারবেন আম চাষিরা।
কৃষি অফিস বলছে, গত দুই সপ্তাহের ঝড়-বাতাসে আমের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সব কিছু ঠিক থাকলে শুধু হাঁড়িভাঙা আম বিক্রি করে এ বছর ১৫০ কোটি টাকার ব্যবসা করতে পারবেন জেলার আম চাষি ও ব্যবসায়ীরা। সঙ্গে গত বছরের মতো এবারও হাঁড়িভাঙা বিদেশে পাঠানোর সুযোগ তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে আম চাষিরা বলছেন, এবার আমের ফলনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্রা অতিরিক্ত হরমোন ব্যবহার। প্রতিটি গাছে শুরুতে যে পরিমাণ আমের গুটি ছিল, তা এখন অর্ধেকে নেমেছে। বাগান কেনা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও মৌসুমী ফল ব্যবসায়ীদের পরামর্শে গাছের গোড়ায় হরমোন দিয়ে অতিরিক্ত ফলনের আশায় গুড়েবালি পড়েছে। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের প্রভাবে ফিকে হতে বসেছে অনেক আম চাষির স্বপ্ন।
কম ফলনের জন্য শুধু কীটনাশকই নয় প্রকৃতির কাছেও অসহায় হাঁড়িভাঙা ঘিরে ঘুরে দাঁড়নোর স্বপ্ন দেখা হাজারো আম চাষি।
রংপুরের মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ উপজেলার চাষিরা জানান, এ মৌসুমে আম গাছে প্রচুর মুকুল এসেছিল। কিন্তু ঘন ঘন বৃষ্টি আর প্রথম দফার ঘূর্ণিঝড়ে মুকুলগুলো ঝরে যায়। দ্বিতীয় দফায় আবারও ঘূর্ণিঝড় ও শিলাবৃষ্টির কারণে গুটি আমেরও একটি অংশ ঝরে যায়।
এছাড়া গেল রমজান মাসে রোজা এবং ঈদের ব্যস্ততার কারণে বাগান পরিচর্যায় কিছুটা অবহেলা হয়েছে। সব মিলিয়ে এবার ফলন কম হয়েছে।
তবে যারা সঠিক পরিচর্যা করেছেন, সময় মতো ভিটামিন ও কীটনাশক স্প্রে করেছেন তাদের আম ভালো হয়েছে। তারপরও আমের বিপণন ও সংরক্ষু ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তায় রয়েছে চাষিরা।
হাঁড়িভাঙা আমের হাটখ্যাত মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জের রাস্তাঘাটের বেহাল দশায় দূর-দূরান্তের ক্রেতাদের ভোগান্তির কারণে বাজার ধরতে অনেক কষ্ট পেতে হয় চাষি ও ব্যবসায়ীদের।
কৃষিবিভাগ ও চাষিদের ভাষ্য মতে, রংপুরে হাঁড়িভাঙা আমের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয় প্রায় ৩০ বছর আগে। শুরুতে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পদাগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকায় ব্যাপক হাড়িভাঙ্গা আমের চাষ হতো। জনপ্রিয়তার কারণে এখন রংপুরের প্রত্যেকটি উপজেলার পাশাপাশি নীলফামারীর সৈয়দপুর, সদর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা, চিরিরবন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এই আমের বাগান।
হাঁড়িভাঙা আমের বৈশিষ্ট্য হলো এটি আঁশবিহীন, মিষ্টি ও সুস্বাদু। এই আমের আঁটিও খুব ছোট। ছাল পাতলা। প্রতিটি আমের ওজন হয় ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম। মৌসুমের শুরুতে হাঁড়িভাঙার চাহিদা বেশি থাকায় এর দাম কিছুটা বেশি হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে প্রতি কেজি হাঁড়িভাঙা আকার ভেদে ৮০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে পারে।
গত এক দশকে দেশজুড়ে জনপ্রিয়তা বেড়েছে হাঁড়িভাঙার। সঙ্গে সরকারের পৃষ্টপোষকতায় বিদেশেও রপ্তানির সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে।
হাঁড়িভাঙা আমের সম্প্রসারক অনেকেই। তাদের মধ্যে দুজন হলেন মিঠাপুকুরে লুৎফর রহমান ও আবদুস সালাম সরকার। তারা ১৯৯০ সালের পর থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাঁড়িভাঙা আম চাষ শুরু করেন। আবদুস ছালামের ১৪ একর জমিতে ২৫টি আমের বাগান রয়েছে।
হাঁড়িভাঙার সম্প্রসারক হিসেবে পরিচিত এই আম চাষি বলেন, আমি দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে হাঁড়িভাঙা আমের চাষ করছি। আমার দেখাদেখি এখন রংপুরে কয়েক লাখ হাঁড়িভাঙা আমের গাছ রোপণ করেছেন আম চাষিরা। এই আম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন দেশে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন। অনেক সুনাম রয়েছে। আমরা এটা বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানি করতে চাই।
এ বছর ৬১৩ হেক্টর জমিতে আমের চাষ কম হয়েছে জানিয়ে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, আমরা শুরু থেকেই হাঁড়িভাঙা আমের মানসম্মত উৎপাদন নিশ্চিত করতে হরমোন প্রয়োগকে নিরুৎসাহিত করে আসছি। তারপরও গোপনে অনেক চাষি মাত্রা অতিরিক্ত হরমোন ব্যবহার করেছেন। জেলায় ১ হাজার ৮৮৭ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ফলন কম হলেও হেক্টর প্রতি ১২ থেকে ১৫ টন আম আসবে। জুনের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে এই আম বাজরে আসবে।
তিনি আরও জানান, সরকার নির্ধারিত সময়ের আগে আম বাজারজাত না করার জন্য আম চাষিদের অনুরোধ জানানো হয়েছে। কেননা আগাম লাভের আশায় আম বাজারজাত করলে হাঁড়িভাঙা আমের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যাবে না। এ আমের প্রতি মানুষের খারাপ ধারণা তৈরি হবে।