সওজের শীর্ষ ঠিকাদার রানা বিল্ডার্স

মামা ভাগনে ভাতিজার দখলে সড়কের এক-পঞ্চমাংশ কাজ

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ বিকাল ০৫:২৩, মঙ্গলবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২১, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪২৮
ফাইল ফটো
ফাইল ফটো

শামীম রাহমান

বছর তিনেক আগেও সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রানা বিল্ডার্স লিমিটেডের কাজ চলমান ছিল ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকার। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি সওজের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন করছে। এ সময়ে সওজের উন্নয়নকাজের ঠিকাদারি পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী সব স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানকে পেছনে ফেলে শীর্ষে উঠে এসেছে রানা বিল্ডার্স।

 

 

প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলম। তার এক ভাগনে ও এক ভাতিজাও সওজের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। গত আড়াই বছরে মোহাম্মদ আলমের ভাগনে ও ভাতিজার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও কাজ পেয়েছে হাজার কোটি টাকার বেশি। রানা বিল্ডার্সের মোহাম্মদ আলম এবং তার ভাগনে ও ভাতিজা মিলে বর্তমানে সওজের পাঁচ ভাগের এক ভাগ উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন করছেন।

মোহাম্মদ আলমের দাবি, ৪২ বছর আগে মাত্র ৫০ হাজার টাকার উন্নয়নকাজ দিয়ে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এরপর পর্যায়ক্রমে ব্যবসার পরিসর বাড়িয়েছেন। গড়ে তুলেছেন রানা বিল্ডার্সের মতো দেশের অন্যতম বৃহৎ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া বর্তমানে তার এক ভাগনে নাজমুল হাসান পরিচালনা করছেন হাসান টেকনো বিল্ডার্স নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ারিং নামে আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী হিসেবে নাম রয়েছে তার এক ভাতিজা জুলফিকার হোসেন মাসুদ রানার।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে নেয়া ট্রেড লাইসেন্সে রানা বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলম স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করেছেন কুমিল্লা সদরের বাদুড়তলার মনিহার নিকেতন। যদিও স্থানীয় কয়েকটি সূত্র বলছে, তার পৈতৃক নিবাস কুমিল্লার লাকসামে। ঢাকায় রানা বিল্ডার্সের অফিস রাসেল স্কয়ারে।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, চার দশকের বেশি সময় ধরে ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত মোহাম্মদ আলমের উত্থান হয়েছে মূলত গত এক দশকে। এর আগে সওজসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার ছোট ছোট কাজ করত রানা বিল্ডার্স। ২০১০ সালের পর থেকেই সওজের বড় বড় উন্নয়নকাজ পেতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। 

পটুয়াখালীর শেখ রাসেল সেতু, খেপুপাড়া সেতু, মহিপুর সেতু, জিঞ্জিরা-দোহার মহাসড়ক, যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর মহাসড়ক, জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল-জামালপুর মহাসড়ক, কাঁচপুর-ভৈরব-সিলেট-জাফলং মহাসড়ক, দৌলতদিয়া-খুলনা-যশোর মহাসড়ক, লাকসাম-মাইজদী মহাসড়ক, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েসহ একাধিক বড় বড় প্রকল্পের কাজ করেছে রানা বিল্ডার্স। 

এছাড়া বর্তমানে কুমিল্লা-নোয়াখালী মহাসড়ক, আহলাদিপুর-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক সড়ক, নোয়াপাড়া-বাগেরহাট-পিরোজপুর আঞ্চলিক সড়ক, কিশোরগঞ্জ-করিমগঞ্জ-চামড়াঘাট জেলা মহাসড়ক, কুমিল্লায় পরিবহন চালকদের জন্য বিশ্রামাগার নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে রানা বিল্ডার্স সওজের এত বেশি কাজ করছে যে প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্সের বিপরীতে কাজ করার সক্ষমতাও উত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। এছাড়া হাসান টেকনো বিল্ডার্স ও মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ারিংও মোটা অংকের উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন করছে।

কুমিল্লার স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রানা বিল্ডার্স, হাসান টেকনো বিল্ডার্স ও মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এ উত্থানের নেপথ্যে সেখানকার এক প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের হাত রয়েছে। মোহাম্মদ আলম ও তার দুই ভাগনে-ভাতিজা এসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তিনটির ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ওই সাংসদের। তার প্রভাব-প্রতিপত্তির জেরেই রানা বিল্ডার্স সওজের শীর্ষ ঠিকাদারে পরিণত হয়েছে।

রানা বিল্ডার্স ও এর সহযোগী দুই প্রতিষ্ঠান মূলত দরপত্র প্রক্রিয়ায় জুড়ে দেয়া বিভিন্ন শর্তের সুযোগ নিচ্ছে বলে সওজের প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা জানিয়েছেন। তারা জানান, সওজের উন্নয়নকাজের জন্য দরপত্রে এমন কিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হচ্ছে যেগুলো শুধু রানা বিল্ডার্সই পূরণ করতে পারবে অথবা পূরণ করার ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। এ প্রক্রিয়ায় ভাগনে-ভাতিজাদের প্রতিষ্ঠান দুটিও এখন সম্পৃক্ত হয়েছে। তাদের এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সওজের কর্মকর্তাদের যোগসাজশেরও অভিযোগ তুলেছেন সংস্থাটির প্রকৌশলী-ঠিকাদাররা।

গত এক দশকের মধ্যে সওজ অধিদপ্তরে রানা বিল্ডার্স সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে সর্বশেষ আড়াই বছরে। সওজের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রানা বিল্ডার্সের চলমান কাজের চুক্তিমূল্য ছিল ৩ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। যদিও ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিলেও  চলমান কাজের মূল্য ছিল মাত্র ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত আড়াই বছরের বেশি সময়ে আরো ২ হাজার ২১৫ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ পেয়েছে রানা বিল্ডার্স। অন্যদিকে মোহাম্মদ আলমের ভাগনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিমিটেডের বর্তমানে চলমান কাজের মূল্য ৭৭০ কোটি টাকা। ভাতিজার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের চলমান কাজের মূল্য ৩১১ কোটি টাকা।

প্রসঙ্গত, শেষ হওয়া কাজের বকেয়া বিল পরিশোধ ও নতুন কার্যাদেশের কারণে প্রতিনিয়ত চলমান কাজের মূল্য হালনাগাদ হয়। সওজের ঠিকাদারদের চলমান কাজের মূল্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্য ঠিকাদারদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে এ তিন প্রতিষ্ঠান। তিন প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত সওজের ৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন করছে।

গত আড়াই বছরে রানা বিল্ডার্স সওজের শীর্ষ ঠিকাদারে পরিণত হলেও প্রতিষ্ঠানটি কিংবা প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারীদের সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানেন না সওজের ঠিকাদাররা। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে সওজ অধিদপ্তরের ঠিকাদারি সমিতির একজন নেতা বণিক বার্তাকে বলেন, চার-পাঁচ বছর আগেও আমরা রানা বিল্ডার্সের নাম জানতাম না। এমনকি এখনো আমরা প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ভালোভাবে চিনিই না। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি একের পর এক কাজ বাগিয়ে নিয়েছে।

ঠিকাদার সমিতির ওই নেতার অভিযোগ, কৌশলে ঠিকাদারি লাইসেন্সের মানকে শক্তিশালী করে একের পর এক কাজ পেয়ে যাচ্ছে রানা বিল্ডার্স। তবে একসঙ্গে এত সব কাজ করার সক্ষমতা নেই প্রতিষ্ঠানটির। এজন্য নিজেদের নামে কাজ নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কাজ করায় তারা। পাশাপাশি মোটা অংকের কমিশন নিয়ে রানা বিল্ডার্স অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাইসেন্স ভাড়া দিচ্ছে।

রাজনৈতিক প্রভাব, পেশিশক্তির প্রয়োগ, অবৈধ লেনদেন করে রানা বিল্ডার্স আজকের এ অবস্থানে এসেছে বলে এ সময় ঠিকাদার সমিতির ওই নেতা আরো অভিযোগ করেছেন।

বণিক বার্তার কাছে হাসান টেকনো বিল্ডার্স ও মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ারিংকে নিজের প্রতিষ্ঠানের ‘সিস্টার কনসার্ন’ হিসেবে দাবি করেছেন রানা বিল্ডার্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলম। বর্তমানে তার ও  সওজ অধিদপ্তরের পাঁচ ভাগের এক ভাগ উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন করছে মামা-ভাগনে-ভাতিজার তিন প্রতিষ্ঠান।

যদিও লাইসেন্স ভাড়া দেয়ার অভিযোগটি পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন রানা বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলম। তার দাবি, সরকারি সব ধরনের আইন ও নীতিমালা মেনেই ঠিকাদারি কাজ করেন। নিজেরা সরাসরি কাজ করার পাশাপাশি কোথাও জয়েন্ট ভেঞ্চার আবার কোথাও সাবকন্ট্রাক্টর দিয়ে কাজ করান।

 এ প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, কেউ যদি একবার ওপরে উঠে যায়, তাহলে তার পেছনে অনেক মানুষ লাগে। ক্ষতি করার চেষ্টা করে। আমার ক্ষেত্রে যেসব অভিযোগ উঠেছে সেগুলোও একই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ৪২ বছর ধরে আমি ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এ সময়ে কোনো কাজ পাওয়ার জন্য একটি পয়সাও কোথাও আমি অনিয়ম করিনি। সবসময় দেশ ও দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছি।

গত আড়াই বছরে প্রায় ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কাজ পাওয়ার বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, সওজ অধিদপ্তরে আমার প্রতিষ্ঠানের ১ হাজার কোটি টাকার বেশি বিল বকেয়া রয়েছে। বিলগুলো পরিশোধ হয়ে গেলে চলমান কাজের মূল্য অর্ধেকে নেমে যাবে।

কভিড পরিস্থিতি, নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন করে লোকসান গোনাসহ নানা কারণে গত দেড় বছরে রানা বিল্ডার্স কোনো দরপত্রে অংশগ্রহণ করেনি বলে এ সময় আরো দাবি করেন তিনি।

বণিক বার্তা

বিষয়ঃ বাংলাদেশ

Share This Article