তৃণমূলে চিকিৎসা সেবা ॥ সামাজিক স্বাস্থ্যে বিস্ময়কর অগ্রগতি

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১১:৪৯, মঙ্গলবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২১, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪২৮
  • স্বাধীনতার ৫০ বছরে মাতৃ ও শিশু মৃত্যু রোধ এবং টিকায় চমকে দেয়ার মতো সাফল্য
  • চিকিৎসায় বেসরকারী খাতের ব্যাপক অংশগ্রহণ

স্বপ্না চক্রবর্তী ॥ তলাবিহীন ঝুড়ির গল্প ছাপিয়ে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে সাফল্যের চূড়ায় ওঠার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ভেঙ্গে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভাবিয়ে তুলেছিল পুরো বিশ্বকে। অভুক্ত দেশবাসীর বেশিরভাগই ভুগছিল পুষ্টিহীনতায়। মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার ছিল আশঙ্কার অন্যতম কারণ। বালাই ছিল না পরিবার পরিকল্পনার। প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে স্যানিটেশন বলে কিছুই ছিল না। খোলা মাঠেই প্রাকৃতিক কর্ম সাধনই ছিল যেন নিয়তি। মাত্র ৫০ বছরে প্রেক্ষাপট পাল্টে আধুনিক বাংলাদেশের সামাজিক খাত আজ বিশ্বের বিস্ময়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমেছে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হার। পরিবার-পরিকল্পনায় বিশ্বের মধ্যে মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। স্যানিটেশন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে অপুষ্টিহীনতার বাংলাদেশ আজ নতুন গল্প লিখছে। মূল স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসা সেবার সম্প্রসারণ ও সুযোগ বাড়লেও, মান নেমে গেছে নিচে। বিপরীতে স্বাস্থ্য সেবায় বেসরকারী খাতের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির কারণে চিকিৎসা সেবা ব্যয়বহুল এবং সাধারণ মানুষের বাইরে চলে গেছে। ফলে মান সম্পন্ন চিকিৎসার জন্য দেশের রোগীদের বাইরে গমন বেড়েছে। বিপরীতে সামাজিক খাতের সূচকগুলোর ব্যাপক অগ্রগতির অভূতপূর্ব অর্জন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বহু দেশ সামাজিক খাতের এই অগ্রগতির কেবল প্রশংসাই করছে না, অনুকরণও করছে অনেক দেশ।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে মূলত প্রাথমিক এবং প্রতিরোধমূলক সেবা দিয়ে শুরু চিকিৎসা কার্যক্রম। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মাত্র ছয়টি মেডিক্যাল কলেজ, একটি ডেন্টাল কলেজ ও পিজি (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতাল দিয়ে মধ্যম ও তৃতীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা শুরু হয়। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং সবার জন্য স্বাস্থ্য চাহিদা পূরণের লক্ষ্য অর্জন হওয়া এবং জনগণের স্বাস্থ্য চাহিদার পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রমান্বয়ে দেশে প্রতিষ্ঠিত এবং সম্প্রসারিত হতে থাকে মধ্যম পর্যায়, তৃতীয় পর্যায় ও বিশেষায়িত হাসপাতাল। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে সরকারীভাবে প্রায় দুইশ’ মধ্যম, তৃতীয় এবং বিশেষায়িত পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে। হৃদরোগ, কিডনি, যক্ষ্মা, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগের ব্যবস্থাপনায় দেশে এখন অর্ধশতাধিক তৃতীয় পর্যায় ও বিশেষায়িত হাসপাতাল সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।

টানা তিনবার দায়িত্ব পালন করা শেখ হাসিনা সরকার রাজধানী ঢাকা থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্য অবকাঠামোকে বিস্তৃত করেছেন। এখন দেশের অনেক জেলায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। অনুকূল পরিবেশে বেসরকারী পর্যায়েও গড়ে উঠেছে সাধারণ ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে শুরু করে উচ্চমানের মধ্যম, তৃতীয় পর্যায় এবং বিশেষায়িত আধুনিক স্বাস্থ্য স্থাপনা। বিশ্বমানের জটিল অস্ত্রোপচারসহ প্রতিদিন অসংখ্য রোগীর চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে এসব হাসপাতালে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে বর্তমানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র একদিনে তৈরি হয়নি। গত পাঁচ দশকের পথ চলায় সবচেয়ে সফলতা এসেছে সামাজিক স্বাস্থ্য খাতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, মা ও নবজাতকের ধনুষ্টঙ্কার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া, পোলিও মাইলাইটিস, হাম ও রুবেলা এই ১০ রোগের বিরুদ্ধে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচী পরিচালিত হচ্ছে। ইপিআই কর্মসূচীর মাধ্যমে সারাদেশে বিনামূল্যে এ টিকাগুলো দেয়া হয়। ১৯৮৫ সালে টিকাদানের হার মাত্র দুই শতাংশ হলেও বর্তমানে তা ৯৮ শতাংশেরও বেশি। এ কর্মসূচীর ফলেই দেশে মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমানোর পাশাপাশি পঙ্গুত্ব রোধ করা সম্ভব হচ্ছে। টিকাদান কর্মসূচীতে বাংলাদেশের সফলতার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার দিয়েছে গ্লোবাল এ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন এবং ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)।

স্বাধীনতার পর ১৯৮৬ সালের জরিপ অনুযায়ী-প্রতি লাখ জীবিত শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ৬৪৮ জন প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হতো। ২০১৫ সালে মাতৃ মৃত্যু কমে ১৮১ জনে দাঁড়ায়। ২০২২ সালের মধ্যে মাতৃ মৃত্যু প্রতি লাখে কমিয়ে ১২১ জনে আনার জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এছাড়া ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) তা কমিয়ে ৭০ জনে আনার লক্ষ্য কার্যক্রম চলছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৮৬-৯০ সালে প্রতি লাখে ৫৭৪ জন, ১৯৯১-৯৫ সালে ৪৮৫ জন, ১১৯৬ সালে ৪৪৮ জন, ১৯৯৮-২০০০ সালে ৩২২ জন, ২০০৭ সালে ২৯৮ জন, ২০১০ সালে ১৯৪ জন, ২০১৫ সালে ১৭৬ জন, ২০১৮ সালে ১৬৯ জন এবং ২০১৯ সালে ১৬৫ জন গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু হয়।

জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) এক গবেষণার প্রেক্ষিতে জানা যায়, গত ১০ বছরে মাতৃমৃত্যু হার কমেছে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে প্রায় ৯৪ জন। যদিও গত ১০ বছরের পরিসংখ্যানে কিছুটা উন্নতি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ৭০ জনের নিচে নিয়ে আসার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। এ লক্ষ্যে প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশের আনাচে-কানাচে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে গেছে। মায়েদের হোম ডেলিভারিতে নিরুৎসাহিত করতে মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করছেন। বন্ধ করা হচ্ছে যত্রতত্র ও অস্বাস্থ্যকর ক্লিনিকে মায়েদের ডেলিভারি। নিপোর্টের গবেষণায় বলা হয়, দেশের মাতৃমৃত্যু হারের কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষরণে ৩১ শতাংশ, একলামশিয়া ২৪ শতাংশ, পরোক্ষ কারণে ২০ শতাংশ, অনির্ধারিত কারণে ৮ শতাংশ, গর্ভপাত জটিলতায় ৭ শতাংশ, অন্যান্য কারণে ৭ শতাংশ এবং অমানসিক শ্রমে ৩ শতাংশ মৃত্যু হয়। যে অবস্থা পরিবর্তনে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো।

পরিবর্তন এসেছে পরিবার পরিকল্পনার সূচকেও। ২০১৯ সালে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩২ শতাংশে নেমে আসে। ২০১৫ সালে যা ছিল ১.৩৭ শতাংশ। এ ছাড়া ঝরে পড়া ও অসম্পূর্ণ প্রয়োজনের (আনমেট নিড) হারও বেশ হ্রাস পেয়েছে। যা ছিল যথাক্রমে ৩৭ শতাংশ ও ১২ শতাংশ। প্রজনন সক্ষম (১৫-৪৯ বছর) নারীদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির প্রতি সন্তুষ্টির হার ৭৭.৪ শতাংশ। যা আগে ছিল ৭২.৬ শতাংশ (এসভিআরএস-২০১৪)। শুধু অর্থনৈতিক সূচক নয়, বাংলাদেশ গত পঞ্চাশ বছরে মানবসম্পদ সূচকেও গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি করেছে। জাতিসংঘের সূচকে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৭৩.২ শতাংশ। এই সূচকের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে মূলতঃ শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৫৩ জন। যেটি ২০১৮ সালে এসে প্রতি হাজারে মাত্র ২২ জনে নেমে আসে। এছাড়া বিবিএস ১৯৮১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর সংখ্যা দিয়েছে প্রতি হাজারে ২শ ১২ জন। যেটি ২০১৮ সালে হয়েছে প্রতি হাজারে ২৯। ১৯৯১ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ৪.৭৮ শতাংশ। সেটি এখন ১.৬৯ শতাংশে নেমে এসেছে।

দেশের সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আরেক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচী, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাস, তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে চলমান কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম বিশ্বের অনেক দেশের কাছে রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বিশ্ব মহামারী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ও মৃত্যুরোধে এখনও পর্যন্ত সফলতার পরিচয় দিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের অনেক দেশ এখনও পর্যন্ত করোনার সংক্রমণরোধে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করতে না পারলেও বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ১০ কোটি মানুষের টিকাদান সম্পন্ন হয়েছে। যে কার্যক্রম সফল করার জন্য অন্যতম দাবিদার এইসব কমিউনিটি ক্লিনিক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, গ্রামীণ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বর্তমান সরকার সারাদেশে ১৩ হাজার ৮৮১টি কমিউনিটি চালু রেখেছে। এসব ক্লিনিক থেকে দৈনিক গড়ে ৩০ জন সেবা নেন। মা, নবজাতক ও অসুস্থ শিশুর সমন্বিত সেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেয়া হচ্ছে এসব হাসপাতালে। শুধু তাই নয় এখানে রয়েছে শিশু ও মায়েদের টিকাদানের ব্যবস্থা। ২৭ ধরনের ওষুধ ছাড়াও শিশুদের অণুপুষ্টিকণার প্যাকেট দেয়া হচ্ছে কমিউনিটি হাসপাতালগুলোতে। সারাদেশের গ্রামের মানুষের ঘরের দোরগোড়ায় পরম বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্লিনিকগুলো।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আলোচনা উঠলেই কমিউনিটি ক্লিনিককে বাদ দিয়ে সেই আলোচনা পূর্ণ হয় না। স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পেছনে আছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ও উদ্যোগ। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক। অনেকে দাবি করেন, কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এমনকি কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্যগাথা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি পুস্তিকাও রয়েছে। যার নাম ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: হেলথ রেভল্যুশন ইন বাংলাদেশ।’

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে একটা সময় ছিল যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, মা ও নবজাতকের ধুনষ্টঙ্কার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া, পোলিং, হাম মহামারী আকার ধরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই অবস্থা আর নেই। বিশ্বের যে ৩০টি দেশে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা সর্বাধিক বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। ১৯৯৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যক্ষ্মাকে গ্লোবাল ইমার্জেন্সি ঘোষণা করার পর থেকেই বাংলাদেশ সরকার এটি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। যার ফলে সরকার দেশের সব নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে যক্ষ্মা শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা প্রদান করছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর প্রধান লক্ষ্য দেশে যক্ষ্মারোগী, মৃত্যু এবং সংক্রমণের হার এমন পর্যায়ে কমিয়ে আনা, যাতে যক্ষ্মা একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচিত না হয়। এই কর্মসূচী বাস্তবায়নে ২০১৫ সালের পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি নতুন কৌশল অনুমোদন করে। যার আলোকে ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে যক্ষ্মায় মৃত্যুহার ৯০ শতাংশ কমানো (২০১৫ সালের তুলনায়) এবং নতুনভাবে সংক্রমিত যক্ষ্মা রোগীর হার ৮০ শতাংশ (২০১৫ সালের তুলনায়) কমিয়ে আনা যায় সেই লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। দেশে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টঙ্কারের মতো রোগও।

তবে স্বাস্থ্যখাতে এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে বিবেচিত হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক পোলিওমুক্ত বাংলাদেশের স্বীকৃতি। সংস্থাটি ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করে। আর এই ঘোষণার ফলে বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচীর সাফল্য প্রমাণ হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশকে পোলিওমুক্ত করার জন্য ১৯৯৫ সাল থেকে জাতীয় টিকা দিবস পালন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০০৬ সালের ২২ নবেম্বর সর্বশেষ পোলিও রোগী শনাক্ত হয়। তখন থেকে বাংলাদেশ পোলিওমুক্ত অবস্থায় ছিল। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধানের কারণে বাংলাদেশকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করা হয়নি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে বলা হয়, আমেরিকা অঞ্চলকে ১৯৯৪ সালে, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলকে ২০০০ সালে ও ইউরোপকে ২০০২ সালে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করা হয়।

শুধু তাই নয়, ‘২০১০ সালে প্রকাশিত গুড হেলথ এ্যাট লো কস্ট : টোয়েন্টি ফাইভ ইয়ারস অন’ শীর্ষক বইয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অগ্রগতির যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়, তার মধ্যে ছিল বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচী। স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচী (ইপিআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব। দেশের শূন্য থেকে ১৮ মাস বয়সী সব শিশু এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী সন্তানধারণে সক্ষম সব নারীকে টিকাদানের মাধ্যমে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস করা, সংক্রামক রোগ থেকে শুরু করে পঙ্গুত্ব রোধ করা এ কর্মসূচীর মূল লক্ষ্য।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক লেভেল-১ (মডেল ফার্মেসি) এবং লেভেল-২ (মডেল মেডিসিন শপ)-এর বৈশিষ্ট্য অনুমোদন দেয়া হয়। মডেল ফার্মেসিগুলো গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট দিয়ে পরিচালিত হয়। ইতোমধ্যে ২২টি জেলায় ৪২১টি মডেল ফার্মেসি ও মডেল মেডিসিন শপ উদ্বোধন করা হয়েছে। ফার্মাকোভিজিল্যান্সের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের এডিআরএম সেল ডব্লিউএইচও ওপসালা মনিটরিং সেন্টারের ১২০তম সদস্যপদ পেয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন বা পরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে, তা পূরণ বা বাস্তবায়নে সম্মুখসারিতে আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাস্থ্যে সফল ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রয়োগের স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘ ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ডিজিটাল হেলথ ফর ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট’ পুরস্কার দেয়। দেশের স্বাস্থ্য খাত নতুন স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, স্বাস্থ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যকৌশল, স্বাস্থ্যনীতি আত্মস্থ করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কোথায় কী ঘটছে, তার ওপর নজর রেখেছেন এই খাতের সরকারী ও বেসরকারী কর্মকর্তা, বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা। নতুন কিছু পেলেই তা দেশে এনে নিজেদের মতো করে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, বিশ্বের খুব কম দেশই আছে, যারা ই-হেলথ এবং স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা (হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম) বাংলাদেশের মতো এগিয়ে নিতে পেরেছে।

স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের কাজটি করছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন একটি বিভাগ হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস)। এমআইএসের লক্ষ্য স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা, ই-হেলথ ও মেডিক্যাল বায়োটেকনোলজির উন্নতি করা। এ সব লক্ষ্য অর্জনের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল আছে এমআইএসের। ২০১৫ সালে স্বাস্থ্য বাতায়ন নামে কল সেন্টার চালু করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এর নম্বর ১৬২৬৩। ২৪ ঘণ্টা এই সেন্টার খোলা থাকে। এখানে ফোন করে বিনা মূল্যে চিকিৎসকের পরামর্শ ও স্বাস্থ্যতথ্য পাওয়া যায়। এখানে কর্মরত চিকিৎসকেরা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্য বাতায়নের মতো কল সেন্টারের গুরুত্ব আরও বেশি অনুভূত হয়েছে। হাসপাতাল, ক্লিনিক বা চিকিৎসকের কাছে যেতে না পারা মানুষ স্বাস্থ্য বাতায়নে ফোন করে চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ নিয়েছেন। এছাড়া, টেলিমেডিসিন সেবা চালু আছে প্রায় ১০০ হাসপাতালে। এর মাধ্যমে উপজেলা হাসপাতালে থাকা রোগী ঢাকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পান। তবে এসব উদ্যোগ বা ব্যবস্থা যদি কাজে না লাগে অথবা প্রয়োজনের সময় মানুষ যদি সেবা না পান, তা হলে সরাসরি অভিযোগেরও ব্যবস্থা আছে।

শুধু তাই নয়, জাতীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল থেকে শুরু করে চালু সবগুলো কমিউনিটি ক্লিনিকে একটি করে কম্পিউটার এবং ২৪ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীকে টেবলেটসহ ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে মাঠ থেকে হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ ছাড়াও টেলিমেডিসিন সেবা, ভিডিও কনফারেন্স, স্বাস্থ্যশিক্ষা, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ নিয়মিত করা হয়। এমআইএস বর্তমানে হেলথ সিস্টেম স্ট্রেনদেনিং নামে একটি কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে। এই কর্মসূচীতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিটি সেবা প্রতিষ্ঠানের মান, দক্ষতা ও কার্যকারিতা যাচাই করা হয়। তার ভিত্তিতে প্রতিবছর সেরা প্রতিষ্ঠানকে ‘হেলথ মিনিস্টারস’ পুরস্কার দেয়া হয়। বিশ্বের ৬৩টি দেশের স্বাস্থ্য খাতে ডিএসআইএস-২ নামে একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের ইলেকট্রনিক তথ্য, স্বাস্থ্য জনবল, হাসপাতাল অটোমেশন, জনস্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের একটি নেটওয়ার্ক চালু করেছে এমআইএস। দেশগুলোর মধ্যে সফটওয়্যারটি সবচেয়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে বাংলাদেশ।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ ও স্বাস্থ্য খাতের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের পরিধি ও মান বাড়াতে হবে।

সর্বোপরি ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সারাবিশ্বের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে তার ভূমিকা, জনবহুল দেশে নির্বাচন পরিচালনায় স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুতা আনয়ন, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেয়া এই বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে আসতে অতিক্রম করতে হয়েছে হাজারো প্রতিবন্ধকতা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত, প্রায় সর্বক্ষেত্রে অবকাঠামোবিহীন সেদিনের সেই সদ্যজাত জাতির ৫০ বছরের অর্জনের পরিসংখ্যানও নিতান্ত অপ্রতুল নয়। সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৮টি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা, শিশুমৃত্যুহার কমানো এবং দারিদ্র্য হ্রাস করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। তাই নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মন্তব্য এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তার মতে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেয়ার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের। বিশেষত শিক্ষা সুবিধা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার ও জন্মহার কমানো, গরিব মানুষের জন্য শৌচাগার ও স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান এবং শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য।

 

সূত্রঃ দৈনিক জনকন্ঠ 

Share This Article