২৫ মার্চ ১৯৭১: মানব সভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্কিত হত্যাযজ্ঞের দিন

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ বিকাল ০৫:১৪, শুক্রবার, ২৫ মার্চ, ২০২২, ১১ চৈত্র ১৪২৮
ফাইল ফটো
ফাইল ফটো

ড. মোঃ আবু সাঈদ
 

২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস। মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত হত্যাযজ্ঞের দিন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাক-হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইট-এর নামে নিরস্ত্র বাঙালির উপর নির্বিচারে চালায় বিশ্ব ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। অপারেশন সার্চ লাইট ছিল বাঙালির একটি প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার এক নারকীয় পরিকল্পনা। পূর্ব পাকিস্তানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা ও বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রাম দমন করার জন্য ২৫ মার্চের যে প্রস্তুতি নিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান, তা ছিল খুবই গোপনীয়। তবে ধারণা করা হয় অবাঙ্গালিরা পরিকল্পনাটি জানতো। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা, বাঙালি সামরিক সেনাসহ কারও মাঝে যাতে সন্দেহ তৈরি না হয় সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছিল তারা।  সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জেনারেল টিক্কা খান বলেছিলেন, আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, মানুষ চাই না। ফলশ্রুতিতে বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে বিভীষিকাময় ভয়াল কালরাত্রি।

বাঙালি যখন তার অধিকারকে আঁকড়ে ধরেছিল, বর্বর পাকিস্তানিরা তখনই বুঝতে পেরেছিল কোনকিছু দিয়েই এই জাতিকে দমিয়ে রাখা যাবে না। তাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সকল পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান। একাত্তরের সেই রাতেই শুরু হয় জঘন্যতম গণহত্যা। তবে গণহত্যার বিপরীতে বাঙালিরা যে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তুলবে তা ভাবতে পারেনি শোষকরা। শুরু হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম।

কবির ভাষায়,
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো। 
রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।

অস্ত্র-শস্ত্র আর ক্ষমতা দিয়ে তারা যে গণহত্যা শুরু করেছিলো তারই প্রতিবাদে বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতারের আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শেষ শত্রু বিদায় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার আহ্বান করেন। জাতির পিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সর্বস্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৫ মার্চ কালো রাতে শুরু হওয়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় ধরে। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয় বহুল প্রতীক্ষিত মহান স্বাধীনতা। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলার সেই নৃশংস ঘটনার স্মরণে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ মহান জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হয়। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি প্রতিরোধ করা হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখা হবে, সর্বোপরি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে নারকীয় ও বর্বরোচিত এই হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে অবহিত করে গণহত্যাকারী ও তার দোসরদের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরা এ গণহত্যা দিবসের মূল উদ্দেশ্য।

আজ ভয়াল ২৫ মার্চ গণহত্যার কালরাত্রি

২৫ মার্চ কালো রাতের প্রেক্ষাপট

১৯৪৭ সালের পশ্চাৎপদ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামের যে রাষ্ট্রের জন্ম সেই রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। শুরুতেই পাকিস্তানি শাসক শ্রেণী বাঙালি জাতির ওপর অত্যাচার নির্যাতন, শোষণ চালাতে থাকে। এই শোষণ অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে শুরুতেই প্রতিবাদ করতে থাকে বাঙালি জাতি। ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসন থেকে এই দেশকে মুক্ত করতে অনেক রক্ত ঝরেছে। অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে এক একটি স্মরণীয় মূহুর্ত।

পূর্ব বাংলার ৫৬ ভাগ বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার পরও বাঙালির ওপর ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানিরা রাষ্ট্রভাষা উর্দু চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল । বাঙালি গর্জে ওঠে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাক সেনারা, ঝরেছিল রক্ত । সেই রক্তে ভেজা মাটি কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছিল। ইতিহাস রচিত হয়েছিল ৫৪'র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে। ৫৮-তে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে লড়াকু উচ্চারণে। ৬২'র হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে শিক্ষা-আন্দোলন। তা থেকে ৬৪'র নির্বাচন। ৬৫'তে পাক-ভারত যুদ্ধ। এরপর ৬৬'র ৬ দফা বাঙালির জীবনের জীয়ন কাঠি। এই আত্ম-উপলব্ধির সময়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে আবির্ভূত  হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৬ দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাঙালি খুঁজে পেল তার ঠিকানা। পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা / তোমার আমার ঠিকানা এবং কালজয়ী স্লোগান জয় বাংলার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি পেল তার আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি, সেই সাথে অবিসংবাদিত নেতার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সেইসব মুহূর্ত। ৬৯'র সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন আইয়ুব খানের পতন ঘটিয়ে ৭০'র নির্বাচনের পথ তৈরি করলো। সেই নির্বাচন প্রমাণ করলো বাঙালি জাতি তার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার চায়।

নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা জাতির সুদৃঢ় এক লৌহকঠিন ঐক্য তৈরি করেছিল নিজেদের মধ্যে। একদিকে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে বাঙালির স্বাধীনতার প্রশ্ন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ-এ হঠাৎ করে ইয়াহিয়া খানের ঘোষণায় ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করা হলো। সেদিন আপামর জনতা বিদ্রোহ-ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। জনতার  উত্তাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। একের পর এক ইতিহাস লেখা হতে থাকলো দিনের পর দিন, প্রতিদিন।  ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশে পতাকা উত্তোলন, যা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে স্বীকৃতি পেল। ৩ মার্চ ঘোষণা হলো পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহার, জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি। এরপর বহুপ্রতীক্ষিত ৭ মার্চ। ইতিহাসের এক বিস্ময়কর ঘটনা, অমর এক কবিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'

বাঙালি জাতি পথ খুঁজে পেয়েছিল সেই দিন, সকল নির্দেশনা ছিল সেই ভাষণে। তারই ওপর ভিত্তি করে প্রস্তুতি চলছিল সমগ্র বাংলাদেশে। একদিকে অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা বাংলাদেশে। অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষণ, ছাত্রদের কুচকাওয়াজ এবং মুক্তিযুদ্ধের আনুষঙ্গিক প্রস্তুতির বিভিন্ন কার্যক্রম। মার্চের শুরু থেকেই উত্তাল ছিলো বাংলার রাজপথ। ঢাকা তখন মিছিলের নগরী। এর মধ্যেই ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। ১৬ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক হয়। দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয় পরদিনই। সেখান থেকে বেরিয়ে মুজিব সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনা শেষ হয়ে যায় নি। এরপর ১৯ মার্চ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ হয় গাজীপুরের জয়দেবপুরে। যার কারণে জয়দেবপুর ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। ২০ মার্চ ঢাকা সেনানিবাসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জরুরী বৈঠক করেন তার সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল হামিদ খান, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ওমরসহ উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে। সেখানেই ২৫ মার্চ রাতের 'অপারেশন সার্চলাইট' অনুমোদন করা হয়। 
এরপরদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমণ্ডির বাসভবনে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে স্পষ্ট ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত  শান্তিপূর্ণ অহিংস অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। নীতির প্রশ্নে কোনই আপস নাই এবং আমাদের ভূমিকা অত্যন্ত পরিস্কার। এদিন ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পঞ্চম দফা বৈঠক হয়। এদিন ভুট্টোর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়।  ২২ মার্চ ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ২৩ মার্চ সারাবাংলায় মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে পালিত হয় প্রতিরোধ দিবস হিসেবে।

এদিকে ২৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্দোলনকারিদের উদ্দেশ্যে বলেন, 'আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। আগামীকালের মধ্যে সমস্যার কোন সমাধান না হলে বাঙালি নিজেদের পথ বেছে নেবে। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোন ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। এদিকে ২৩ থেকে ২৪ মার্চ বাংলার বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। নীলফামারীর সৈয়দপুর, রংপুর, মিরপুরে সাড়ে তিনশ মানুষ নিহত হন। আহত হয় বহু মানুষ। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় চলে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ।

পাকিস্তানি বাহিনীর গোপন পরিকল্পনা প্রস্তুতি

মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে প্রায় প্রতিদিনই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনা হচ্ছিল ঢাকায়। ২৫ মার্চের আগে তা আরো বেড়ে যায়। মার্চের ১৭ তারিখ অপারেশন পরিকল্পনার দায়িত্ব পান ১৪ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা। পরদিনই জেনারেল রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি অপারেশনের পরিকল্পনা তৈরি করেন। পরিকল্পনা হয় সারাদেশে একযোগে অপারেশন পরিচালনা করার। ঢাকাকে কেন্দ্রবিন্দু ধরে খুলনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর ও সিলেটে আক্রমণাত্মক অপারেশন পরিচালনার পরিকল্পনা করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাদের গ্রেপ্তারের। অপারেশন সফল হওয়ার জন্য বাঙালি সৈন্যদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেড়ে নিতে বলা হয়। সব প্রস্তুতি ছিলো অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রেখে। এমনকি পাকিস্তানি ইউনিট কমান্ডারদের এমনভাবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিলো যাতে কারো মধ্যে কোন ধরনের সন্দেহ না হয়। অপারেশনের সফলতা নিশ্চিত ও গোপনীয়তা রক্ষার জন্য স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে সামরিক বাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তাদের বদলি করে সেখানে পাকিস্তানি বাহিনী মোতায়েন করা হয়। 
২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের আগেই বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা ত্যাগ করতে বলা হয়। হত্যা হত্যাযজ্ঞের সময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ৪৮ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে আটকে রাখা হয় ৩৫ জন বিদেশি সাংবাদিকদের। হোটেল থেকে বের হলেই গুলি করার হুমকি দেওয়া হয়। পরে তাদের তল্লাশি চালানো হয়। বাজেয়াপ্ত করা হয় নোটবই, ছবির ফিল্ম ও ফাইল।

ভয়াল সেই কালো রাত

সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়ে পাকিস্তানিরা বাঙালি ধ্বংসযজ্ঞে নামে। বাঙালি বুঝে ফেলে- কিছু একটা ঘটবে। রাতেই পথে নেমে আসে ছাত্র-জনতা এবং গড়ে তোলে অসংখ্য ব্যারিকেড। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। রাত ১০টার দিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর একটি বড় কনভয় যুদ্ধ সাজে শহরের দিকে রওনা হয়। শহরমুখী সেনাবাহিনীর মেকানিক্যাল কলামটি প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ফার্মগেইটে। সেখানে বড় বড় গাছের গুঁড়ি, অকেজো স্টিম রোলার এবং ভাঙা গাড়ির স্তূপ জমিয়ে রাখা হয়েছিল পথ আটকানোর জন্য। মুক্তিকামী বেপরোয়া প্রতিরোধে উন্মুখ জনতার মাঝ থেকে জয় বাংলা স্লোগান উঠছিল। গুলি করে এ প্রতিরোধ ভেঙে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্যাংকগুলো সামনে এগিয়ে যায়। রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ রেসকোর্স ময়দানের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সেনাবাহিনীর অন্তত ৮০টি সাঁজোয়া যানকে পূর্ণ যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। রাত ১১টা ২০ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের চারিদিকে অবস্থান নিতে শুরু করে।

২৫ মার্চ: নজিরবিহীন গণহত্যা

এ আক্রমণের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে সারাদেশের জেলা ও সাব ডিভিশনে বেতার বার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। রাত সাড়ে ১১টার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্ণেল তাজ এর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাদের কনভয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ শুরু করে। ব্যারাকে অবস্থানরত বাঙালি পুলিশ সদস্যরা সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি করে। একই সময়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ বালুচ রেজিমেন্টের সেনারা পিলখানায় ইপিআর-এর ওপর হামলা করে। ব্যারাকে থাকা বাঙালি সেনারা চরম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। পিলখানা ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনস আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারি বাজারসহ সমগ্র ঢাকাতে শুরু হয় প্রচণ্ড আক্রমণ; বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় রাতের অন্ধকারে গুলি, বোমা আর ট্যাংকের আওয়াজে প্রকম্পতি হয় পুরো শহর।

সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা, এবং বস্তিবাসীর ওপর নজিরবিহীন নৃশংসতা চালায়। রাত ১টার পর পাকিস্তানের সেনারা ট্যাংক আর সাঁজোয়া যান নিয়ে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অনেকেই আত্মগোপনে যেতে বললেও বঙ্গবন্ধু যাননি। তিনি বলেছিলেন, আমাকে না পেলে ওরা ঢাকা জ্বালিয়ে দেবে।

বিশ্বের নৃশংসতম গণহত্যা শুরু হয় ২৫ মার্চের মধ্যরাতে। ভয়ংকর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার বাহিনী। হিংস্র শ্বাপদের মতো জলপাই রঙের ট্যাংকগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ-ইপিআর ব্যারাকের দিকে ধেয়ে যেতে থাকে। নিরীহ বাঙালী যখন ঘুমে আচ্ছন্ন তখনই পাকিস্তানিরা অতর্কিত হামলা চালায়। হঠাৎ করেই যেনো ঢাকার আকাশে-বাতাস গর্জে ওঠে রাইফেল, মেশিনগান আর মর্টারের গুলিতে। হত্যাযজ্ঞ চলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থানে। সে রাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা গণমাধ্যমও রেহাই পায়নি জল্লাদ ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা থেকে। অগ্নিসংযোগ, মর্টার শেল ছুঁড়ে একে একে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ ও জাতীয় প্রেস ক্লাব ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ২৫ মার্চ রাতে কি নৃশংসতম হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে তা পরেরদিনের লাশের মিছিল দেখে খুব সহজেই অনুমান করা যায়।

সেই ভয়াল রাতে কত বাঙালিকে প্রাণ দিতে হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকার ভাষ্য, কেবল ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় একলাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও কিছু তথ্য পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তারা যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সর্ম্পকে লিখেছেন, সে রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার হয় আরো ৩০০০ লোক।

সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক- শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি। জঘন্য এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তনের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানি সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশী মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।

পাকিস্তানিরা বর্বর গণহত্যা আর রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার করে বাংলাকে দখল করে শোষণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই নির্মম আক্রমণই বাঙালিকে আরো ক্রুদ্ধ করে তোলে আর স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে।

তাই তো কবি মহাদেব সাহ লিখেছেন

আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি তখন তেরোশত নদী
গেয়ে ওঠে আমার সোনার বাংলা,
সহস্র পাখির কণ্ঠে জয় বাংলা ধ্বনিত হতে থাকে;
আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি, তখন সাতই মার্চ
জেগে ওঠে, শেখ মুজিব ঘোষণা করেন স্বাধীনতা।

২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু এক রাতের হত্যাকাণ্ডই ছিল না, এটা ছিল মূলত বিশ্বসভ্যতার জন্য এক কলংকজনক, জঘন্যতম গণহত্যার সূচনামাত্র। পরবর্তী ৯ মাসে ৩০ লক্ষ নিরাপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা সৃষ্টি করেছিল সেই বর্বর ইতিহাস, নিষ্ঠুরতা ও সংখ্যার দিক দিয়ে ইহুদি হলোকাস্ট (১৯৩৩-৪৫) বা রুয়ান্ডার গণহত্যা (১৯৪৪) কেও অতিক্রম করে গেছে।

সারা পৃথিবীর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা সেদিন নিশ্চুপ ছিলো না। বিভিন্নভাবে ঘুরে ফিরে সংবাদ পৌঁছে যাচ্ছিল দেশে দেশে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকার সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন। তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যা চালাবার অভিযোগ করেন।

গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ঙ্কর গণহত্যার একটি  বলে উল্লেখ করা হয়। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভ তাদের গোপন দলিল অবমুক্ত করে। এতে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাযজ্ঞকে Genocide হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই মুক্তিযুদ্ধে অনেক সাংবাদিকের প্রত্যক্ষ বিবৃতি, ভাষ্য, সাক্ষাৎকার বিভিন্ন সময়ে প্রচারিত হয়েছে, যা থেকে কি নির্মম ছিল এই গণহত্যা তার প্রমাণ উঠে আসে। সারা বিশ্বের মানুষ থমকে দাঁড়িয়েছে। বিবেকের তাড়নায় পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় গণহত্যার বিরুদ্ধে জাগরণ তৈরি হয়েছিল।

শুক্রবার ভয়াল ২৫ মার্চ : গণহত্যা দিবস

বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল পৃথিবীর বিবেকবান মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের এরকম একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক ড্যান কগিন 'টাইম ম্যাগাজিন' এ তার এক লেখায় এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের উদ্ধৃতি প্রচার করেন “We can kill anyone for anything. We are accountable to no one.” বিশ্বখ্যাত এই পত্রিকাটির একটি সম্পাদকীয় মন্তব্য ছিল; “It is the most incredible, calculated thing since the days of the Nazis in Poland.” শুধু দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক মহলের মতেও ১৯৭১ সালে তিন মিলিয়ন বা ত্রিশ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। এই সংখ্যার সমর্থন আছে “National Geographic magazine, Encyclopedia Americana, and Compton’s Encyclopedia” তে।

এই গণহত্যা সম্পর্কে অন্যতম প্রধান পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ডায়েরিতে লেখেন, তিনি বাংলার সবুজ মাঠকে রক্তবর্ণ করে দেবেন “Paint the green of East Pakistan in red”.

২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৫ মার্চ কালোরাতের তথ্য-উপাত্ত জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়াও গণহত্যা দিবসের তথ্য নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিউইর্য়কে জাতিসংঘ সদর দপ্তর এবং জেনাভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে পাঠানো হয়েছে।  

বাংলাদেশের মিশনগুলো যাতে দিবসটি বিশেষভাবে পালন করতে পারে, সেজন্য মিশনগুলোতে তথ্য উপাত্ত পাঠানো হয়েছে । শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, আজকের সুসভ্য বিশ্বসমাজ ও বিশ্বমানবতার অগ্রযাত্রার স্বার্থেও অন্তত এইদিন গণহত্যার মতো পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন এই কারণেও যে, আমরা চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে। এই দিবসকে ঘিরে গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা জাগ্রত করা এবং সাংস্কৃতিক-সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাই হবে আমাদের কাজ। যাতে আর কখনই এইরকম গণহত্যার ঘটনা না ঘটে। তাহলেই ২৫ শে মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্তটি শুধু বাংলাদেশের সাথে সাথে বিশ্ব-ইতিহাসেও একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। জয় বাঙলা।

পরিচিতি: প্রধান প্রশিক্ষক, আর্মি স্কুল অব এডুকেশন এন্ড এ্যাডমিনিস্ট্রেশন
[email protected]

Share This Article