বাংলাদেশ-জাপান পরস্পর অকৃত্রিম বন্ধু

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:২৩, বৃহস্পতিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ২৭ মাঘ ১৪২৮
ফাইল ফটো
ফাইল ফটো

ড. মো. আওলাদ হোসেন


জাপান বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ এবং বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী। জাপান বাংলাদেশের বৈদেশিক সাহায্যের উল্লেখযোগ্য উৎস। বাংলাদেশ জাপানের কাঁচামালের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস এবং বাণিজ্যিক অংশীদার, পাশাপাশি বিনিয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে জাপান ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে আসছে।

 

আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং অস্থির অর্থনৈতিক সম্পর্কের উপর নির্ভর করে যদিও বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও অঞ্চলের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তথাপি জাপান ধারাবাহিকভাবে স্থিতিশীল, তাৎপর্যপূর্ণ, কার্যকর সম্পর্ক বজায় রেখেছে। সম্পর্কগুলো পারস্পরিক আস্থা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ বন্ধুত্বের বৈশিষ্ট্যযুক্ত এবং উন্নয়নে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার জন্য সক্রিয়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।


বাংলাদেশ ও জাপানের জনগণের মধ্যে বিদ্যমান পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অবস্থানকারী জাপানী অধ্যাপক সুয়োশি নারা‘র মতে,  দুই দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কিছু প্রাচীনতম প্রমাণ বা ভিত্তি রয়েছে। প্রায় চারশত বছর পূর্বে জাপানি চিত্রশিল্পীরা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত একটি রঙ জাপানে এনে ব্যবহার করেন, যা এখনও ‘বাঙ্গুরা‘ রঙ নামে পরিচিত। উল্লেখ্য জাপানী ভাষায় ‘বাংলাদেশ‘কে ‘বাঙ্গুরা‘ উচ্চারণ করা হয়।

 

দুই দেশের মধ্যে এই বন্ধনের ভিত্তি চারটি অভিন্নতার উপর প্রতিষ্ঠিত: (১) খাদ্যাভ্যাস- উভয় জাতি ভাত এবং মাছ পছন্দ করে; (২) ধর্মীয় স্মৃতিচারণ-বৌদ্ধ ধর্ম এই ভূমি থেকে জাপানে প্রসারিত হয়েছিল; (৩) নৃতাত্ত্বিক সখ্যতা; এবং (৪) প্রাকৃতিক সম্প্রীতি। কারণ উভয় ভূমিতেই রয়েছে পাহাড়, সমুদ্র, নদী এবং সবুজ।

 

বাঙালিদের প্রতি জাপানি জনগণের অত্যন্ত শ্রদ্ধার কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরাজিত জাপানকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতে বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতের (টোকিও, ১৯৪৬-৪৮) ২১/২২ জন বিচারকের মধ্যে ব্রিটিশ কোটায় নিয়োগ পান একমাত্র বাঙালি বিচারক ডক্টর রাধা বিনোদ পাল (১৮৭৬-১৯৬৭)। তিনি জাপানকে যুদ্ধ অপরাধের জন্য দোষী মনে করেননি এবং তিনি একটি নোট অফ ডিসেন্ট প্রদান করেন। বিচারপতি রাধা বিনোদ পাল এর এই ঐতিহাসিক রায়ে জাপানি জনগণের মনে স্বস্তি, সাহস ও শক্তির আশা জাগিয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার সলিমপুরে জন্মগ্রহণকারী ডক্টর বিচারপতি পাল, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি (১৯৪১-৪৩) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৪৩-৪৪) ছিলেন। যেহেতু  বিচারপতি পাল বাঙালি ছিলেন, তাই জাপান সরকার ও জাপানি জনগণ তৎকালীন ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের তুলনায় বাংলাদেশ ও বাংলার জনগণের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা এবং সহানুভূতিশীল ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পরে জাপানি অর্থনৈতিক সহায়তা এবং বিনিয়োগ ভারতের অন্য কোনো অংশের আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) এসেছিল।



১৯৭১ সালে জাপানের জনগণ এবং সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল এবং সহায়ক হয়ে উঠেছিল, যদিও সেই সময়ে জাপান ছিল  বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল মিত্র। শিল্পোন্নত দেশগুলির মধ্যে  জাপানই প্রথম (১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২)  বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাপান বাংলাদেশকে সাহায্য সহায়তা দিয়ে আসছে। স্বীকৃতির পরপরই, জাপান সরকার তৎকালীন  Parliament member তাকেশি হায়াকাওয়া এর নেতৃত্বে বাংলাদেশের  যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের জন্য একটি অর্থনৈতিক মিশন প্রেরণ করে।

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে জাপান ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে আসছে। বাংলাদেশের স্বনির্ভরতা, দারিদ্র্য বিমোচন এবং অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য জাপানি অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিসটেন্স (ODA) বাংলাদেশের অনুকূলে সবচেয়ে কম শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন করা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য জাপানের ODA সাহায্যের প্রতিশ্রুতি এবং বিতরণ অবস্থার দিকে তাকালে, এটি বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জাপানের অংশগ্রহণের অগ্রণী প্রবণতার একটি উজ্জ্বল চিত্র প্রকাশ করে। বছরের পর বছর ধরে এই দুই  দেশের মধ্যে সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা দৃঢ় থেকে শক্তিশালী হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ জাপানের অনুদান সহায়তার প্রাপক হিসাবে প্রথম স্থানে  রয়েছে।

 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপান সরকারের আর্থিক সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ মেগাপ্রকল্পসহ অসংখ্য উন্নয়নমূলক প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে এবং চলমান রয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার জন্য স্বাধীনতা বিরোধী অশক্তিসমূহ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জাপানের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য, গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা। ঢাকা মহানগরে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে জাইকা‘র সহযোগিতায় নির্মীয়মাণ ‘মেট্রোরেল প্রকল্প‘ বন্ধ করার জন্য উল্লেখিত জঙ্গি হামলায় মেট্রোরেল প্রকল্পে কর্মরত ৫ জন জাপানী প্রকৌশলীকে হত্যা করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, জাপান সরকার যেন ক্ষুব্ধ হয়ে মেট্রোরেল প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। কিন্তু জাপান-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের সম্পর্ক এতই অকৃত্রিম ও শক্তিশালী যে, জঙ্গি হামলার ৭ দিনের মাথায় জাপান সরকার আরও ৫ জন প্রকৌশলী পাঠিয়ে দিয়ে মেট্রোরেল প্রকল্প চালু রেখেছে।

 

অতি সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় জাইকার একটি সমন্বিত উন্নয়ন প্রস্তাব পর্যালোচনা করা হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বীপ মহেশখালী-মাতাবাড়ি নিয়ে একটি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে চাইছে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা।

মহেশখালী-মাতাবাড়িকে নিয়ে এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে জাপানের কিয়াসু দ্বীপের অভিজ্ঞতা নিয়ে। জাপানকে শিল্পোন্নত করতে গত শতাব্দীর ৬০‘এর দশক‘এ জাপান যে ‘প্যাসিফিক বেল্ট’ নীতি গ্রহণ করে, তারই উদ্যোগ হিসেবে কিয়ুসু দ্বীপের ওসাকা পর্যন্ত ১২০০ কিলোমিটার এলাকা শিল্পায়নের জন্য চিহ্নিত করে। যেটি বাস্তবায়নের পর ১০ বছরে জাপানের মাথাপিছু জাতীয় আয় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। জাপানের মোট উৎপাদনের ৮০ শতাংশ আসে সেখান থেকে আর লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ওইসব কল-কারখানায়। কিয়ুসু দ্বীপের ওই অভিজ্ঞতা থেকে মহেশখালী-মাতাবাড়িকে কেন্দ্র করে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার জোনে একই রকম অর্থনৈতিক হাব গড়ে তুলতে চাইছে জাইকা। যেটি বাস্তবায়নে প্রায় ২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ দরকার পড়বে। এর অর্ধেকের কিছু বেশি অর্থাৎ ১ হাজার ২৪ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তার দিতে চাইছে জাইকা। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এই প্রস্তাব অনুযায়ী মাতাবাড়িতে নির্মাণ হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ  কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, সমুদ্রবন্দর ও ইকোনমিক জোন। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি নতুন মাত্রা পাবে।

 

অর্থনৈতিক শক্তিতে অসামঞ্জস্য থাকা সত্ত্বেও জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক একটি উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে সফল এবং সুরেলা সম্পর্ককে চিত্রিত করে। বিগত পঞ্চাশ বছরে উভয় দেশের শাসন পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও জাপান ও বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
 

বিষয়ঃ বাংলাদেশ

Share This Article