অমর্ত্য সেনের বাংলাদেশ বাংলাদেশের অমর্ত্য সেন

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:৪৬, রবিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ২৩ মাঘ ১৪২৮

‘অমর্ত্যের কাজগুলো বাংলাদেশের জনগণের প্রতি প্রতিশ্রুতির প্রতীক, যাদেরকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সময় সমর্থন দিয়েছিলেন। তার শিক্ষায়তনিক কর্মে অমর্ত্য বাংলাদেশের হূদয়জাত উদ্বেগের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছেন, বাংলাদেশের মাটিতে অমর্ত্যের শিকড় দৃঢ়ভাবে গ্রথিত’—রেহমান সোবহান (১৯৯৮)


বাড়ি, বাল্যকাল এবং বিদ্যালয়

এক. ‘বাড়ি কোথায়?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে সাধারণত পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির কথা বলা হয়। কিন্তু অমর্ত্য সেনের কাছে বাড়ি বলতে পূর্বপুরুষের বসতবাটি অথবা এক্সক্লুসিভ কিছু বুঝতে হবে এমনটি নয়। বস্তুত একাধিক আনন্দদায়ক বাড়ি আছে তার। যেমন অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা এবং অপেক্ষাকৃত ছোট ইউনিভার্সিটি শহর শান্তিনিকেতন; কলকাতা, যেখানে অর্থনীতিতে প্রথম পাঠ এবং ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়তা; বার্মার (মিয়ানমার) মান্ডালয়ের কৃষি কলেজ ক্যাম্পাসের কাঠের ঘর এবং ১৯ বছর বয়সে যাওয়া ট্রিনিটি কলেজ, কেমব্রিজ—সবখানেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন।

জন্ম ১৯৩৩ সালের হেমন্তে। বাংলার কৃষকের ঘরে ঘরে যখন ফসল কাটা ও নবান্নের আনন্দ, ঠিক সেই সময় শান্তিনিকেতনে সেন পরিবারে আনন্দ বয়ে এনেছিল এক শিশুর জন্ম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং শিশুটির মায়ের কাছে বিরক্তিকর একই নাম না রাখার পরামর্শ রেখে প্রস্তাব করলেন ‘অমর্ত্য’— ‘কোনো এক জায়গা থেকে আসা যেখানে মানুষ মরে না (অনুমেয়রূপে স্বর্গ)’। অনেককেই এ নামের সাড়ম্বর অর্থ বোঝাতে হয়েছে, তবে তার কাছে অধিকতর আক্ষরিক এবং সম্ভবত অধিকতর ভুতুড়ে অর্থ ‘অপার্থিব’ পছন্দনীয়।

বড় হয়ে তিনি জানতে পেরেছিলেন সেই বছর ইউরোপ নিরানন্দে নিপতিত ছিল—বাড়িঘর আর জীবন ভয়ংকর ক্ষতিগ্রস্ত হয়; শুধু জার্মানি থেকে ৬০ হাজার পেশাজীবী, লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, সুরকার, অভিনেতা ও চিত্রকর দেশান্তরিত হয়ে মূলত ইউরোপের অন্যান্য জায়গায় ও আমেরিকায় চলে যান। 

দুই. তার জন্মের সময় পরিবার ঢাকা শহরে বাস করত। বাংলার পুরনো এক রীতির কারণে ঢাকায় জন্ম নেয়া হয়নি—মায়ের প্রথম সন্তান জন্ম নেয় মাতুলালয়ে, বিয়ের পর আসা তার নতুন বাড়িতে নয়। অবশ্য অমর্ত্য সেন মনে করেন, শিশুজন্মের সময় মেয়ের যথাযথ পরিচর্যা কুটুমকুল করতে পারবে না, মাতৃপক্ষের এমন আস্থার অভাব থেকে এ রীতির সূত্রপাত এবং ‘এ রীতি মেনে আমি, তখনো মাতৃগর্ভে, ঢাকা থেকে শান্তিনিকেতনে আসি জন্ম নিতে এবং দুই মাস বয়সে ঢাকা ফিরে যাই।’

তখনকার ঢাকা ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত এবং ছোট জায়গা; সবসময় জীবন সাবলীল এবং মাধুর্যময়। অথচ ‘ঢাকা এখন দ্রুতগতিসম্পন্ন, এলোমেলোভাবে গড়ে ওঠা বিস্তৃত এবং কিছুটা বিভ্রান্তিকর শহর এবং বাংলাদেশের উদ্যমী রাজধানী।’ পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক উয়ারী এলাকায় অবস্থিত ‘জগত কুটির’ নামে তাদের বাড়িটি ছিল রমনায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের কাছাকাছি। বাড়ির এ নাম জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তার ঠাকুরদার সংশয়বাদের কিছুটা প্রতিফলন ঘটায়, যদিও পরিবারের বেশ কয়েকজন জাতীয়তাবাদী ব্রিটিশ রাজবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জগত কুটির নামটি অমর্ত্য সেনের ঠাকুরমা জগতলক্ষ্মীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শক।  তার জন্মের আগে এই মহিমময়ী মৃত্যুবরণ করেন এবং শুনেছেন যে ঠাকুরমা জগতলক্ষ্মীর বিস্ময়বিমুগ্ধ বিজ্ঞতা নানাভাবে পরিবারের সদস্যদের প্রভাবিত করেছিল। আজও হেঁচকি উঠলে তিনি ঠাকুরমার নির্দেশিত ওষুধ অনুযায়ী ঠাণ্ডা পানিতে কয়েক চামচ চিনি ভালোভাবে মিশিয়ে ধীরে পান করেন। তার ধারণা হেঁচকির কারণে শ্বাসরোধ ঠেকানোর এটাই হচ্ছে অপেক্ষাকৃত সুখবহ দাওয়াই।

তিন. পিতা আশুতোষ সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন পড়াতেন; পিতামহ শারদা প্রসাদ সেন ছিলেন ঢাকার আদালতে বিচারক (এবং আইনি ও হিসাব সম্পর্কিত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত)। মা অমিতা সেন  রবীন্দ্রনাথ উদ্ভাবিত ‘আধুনিক’ ধারার দক্ষ মঞ্চ নৃত্যশিল্পী এবং একটা বাংলা ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন। যখন ‘ভালো পরিবারের’ নারীরা মঞ্চে অবতীর্ণ হতেন না, তখন তিনি কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু নৃত্যনাটকে প্রধান নারী ভূমিকায় মঞ্চে অবতীর্ণ হতেন। শুধু তা-ই নয়, অমিতা সেন সেই আমলে শান্তিনিকেতনে ‘জুডো’ শিখেছেন। ১০০ বছর আগে ঠাকুরের স্কুলে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে এ সুযোগ দেয়ার খবর সম্ভবত স্কুলটি সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয়। 

পিতা-মাতা ঢাকার বাড়িতে খুব সুখী ছিলেন, তেমনি তিনি এবং চার বছরের ছোট বোন মঞ্জু।  যেহেতু বদলির চাকরি, সরকারি চাকুরে বড় কাকা খুব কমই আসতেন, তবে ছুটিতে মেয়ে নিয়ে যৌথ পরিবারে তার আগমন ছিল অমর্ত্য সেনের তরুণ জীবনের তীব্র উপভোগ্য সময়ের শুরু। আবার বড় কাকার ছেলে এ বাড়িতে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত; অন্য কাজিনরাও ঢাকায়ই বাস করত। মোট কথা, এ বাড়ি সবসময় অতিথির আনাগোনায় সরগরম থাকত। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তারা আসতেন, যথা কলকাতা, দিল্লি, বোম্বে, হংকং ও কুয়ালালামপুর; যা শৈশবের কল্পনায় অমর্ত্যের কাছে মনে হতো পুরো পৃথিবী। অতিথিরা তাদের কাজ নিয়ে বালক অমর্ত্য সেনের সঙ্গে গল্প করতেন। উপরের তলার বারান্দায় সুরভিত চম্পা গাছের কাছে বসে ভ্রমণ আর অভিযানের রোমাঞ্চকর গল্প সন্নিবদ্ধ শুনে অমর্ত্য সেন আশা করতেন হয়তো তার জীবনেও এমন দিন আসবে।

ঢাকায় বাস করলেও তাদের শেকড় ছিল গ্রামে। অনেক শহুরে বাঙালির মতো তার পরিবারও দুই প্রজন্ম আগে মানিকগঞ্জের মাত্ত গ্রাম থেকে ঢাকায় আসে। আজকাল মোটামুটি ভালো রাস্তায় কয়েক ঘণ্টায় পৌঁছানো যায় মাত্ত গ্রামে, তবে সেই আমলে নৌকাযোগে বিভিন্ন নদী বেয়ে যেতে লাগত দিনের বেশির ভাগ সময়। অমর্ত্য সেন এখনো ঢাকা ও পৈতৃক পূর্বপুরুষের নিবাস মানিকগঞ্জের মধ্যে নৌকায় করে যাওয়া-আসা এবং বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি রোমন্থন করেন। হয়তো বছরে কয়েক সপ্তাহের জন্য সেখানটায় যাওয়া হতো, কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ শমিত বোধ করে ভাবতেন, ‘বাড়িতে ফিরে এসেছি!’

শুধু পিতৃপুরুষ নয়, মায়ের দিকের দাদু ক্ষিতি মোহন সেনের পরিবারও বাংলাদেশের বিক্রমপুরের সোনারাং থেকে আসা। তিনি ছিলেন ভারতীয় দর্শন এবং সংস্কৃত ও পালি বিষয়ে পণ্ডিত, শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীর শিক্ষক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব ঘনিষ্ঠ লোক। ক্ষিতি মোহন সেন সংস্কৃত, বাংলা, হিন্দি ও গুজরাটি ভাষায় অনেক বিমুগ্ধ বই লিখেছেন। অন্যদিকে দিদিমা কিরণবালা ছিলেন প্রতিভাবান মৃিশল্পের চিত্রকর, যাকে অমর্ত্য সেন দেখেছেন খুব ঘনিষ্ঠভাবে। কিরণবালার অন্যতম একটা গুণ ছিল এই যে, তিনি খুব দক্ষ মিডওয়াইফ বা দাই ছিলেন। সেকেলে শান্তিনিকেতনের সব সন্তান জন্মের বেলায় এমনকি নিজের নাতি-নাতনিদের স্বাস্থ্য বিষয়ে সহায়তা দিতেন; সময়ের আবর্তনে তিনি অনেক সযত্নে গুরুত্বপূর্ণ ডাক্তারি জ্ঞান অর্জন করেন। অমর্ত্য সেন গভীর মনোযোগে দিদিমার কাছ থেকে একাগ্রচিত্তে শুনতেন কী করে শিশুজন্মের সময় পরিচর্যাবিষয়ক সামান্য অবহিত জ্ঞান (যেমন অ্যান্টিসেপটিকসের পর্যাপ্ত এবং বিচক্ষণ ব্যবহার) নিরাপত্তা তথা বেঁচে থাকার জন্য জরুরি। অথচ ওই সময় বাড়িতে জন্মের বেলায় এ বিষয়গুলো প্রায়ই অবজ্ঞা করা হতো। আরো শুনেছিলেন প্রসবকালীন সংগঠিত অহেতুক উচ্চমাত্রায় মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর মর্মন্তুদ বর্ণনা। বাল্যকালে শ্রুত সেই বর্ণনা তার কাছে বাস্তবে ধরা দিল একসময়: ‘পরবর্তীতে যখন মাতৃমৃত্যু ও শিশু রুগ্ণতা আমার নিজের গবেষণার বিষয় হয়ে উঠল, আমি প্রায়ই রান্নাঘরে বেতের মোড়ায় বসে দিদিমার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতার কথা স্মরণ করতাম। তার প্রত্যেক কাজে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আমার মধ্যে ব্যাপক সন্তুষ্টিবোধ জাগ্রত করে।’

চার. ঢাকার মতো অমর্ত্য সেনের অন্য একটা বাড়ি হয়ে উঠল (এবং আছে) বর্তমান পশ্চিম বাংলার শান্তিনিকেতন। প্রারম্ভিকভাবে শান্তিনিকেতনের ভেতর ‘গুরুপল্লীতে’ বিদ্যালয় কর্তৃক বরাদ্দকৃত দাদু-দিদিমার একটা ছোট খড়ের কুটির, অনাড়ম্বর কিন্তু রুচিশীল গৃহ। তারপর ১৯৪১ সালে মা-বাবা শহরের অন্য জায়গা ‘শ্রীপল্লীতে’ নিজেদের জন্য একটা ছোট ঘর বানালেন। নবনির্মিত এ বাড়ির নাম রাখা হলো ‘প্রতীচী’  (সংস্কৃত মানে পশ্চিম দিকস্থ)। অন্যদিকে প্রতীচীর সন্নিকটে দাদু-দিদিমা নিজেদের জন্য একটা বাড়ি বানালেন পাছে কোনো দিন সরকারি আবাসন ছাড়তে হয় এবং বয়োপ্রাপ্তির সঙ্গে ঢাকা ও শান্তিনিকেতন উভয়ের প্রতি অমর্ত্য সেনের ভালোবাসা গড়ে উঠতে থাকে।

তবে সবচেয়ে পুরনো স্মৃতিগুলো কিন্তু ঢাকা কিংবা শান্তিনিকেতনের নয়। ১৯৩৬ সালে তৃতীয় জন্মদিনের ঠিক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নেয়া বাবার চাকরি সূত্রে, তাকে বার্মার মান্ডালয়ে যেতে হয়েছিল। তিনি এ ভ্রমণের ব্যাপারে খুব শিহরিত ছিলেন বটে কিন্তু দিদিমাকে ফেলে যাওয়া তার পক্ষে অত সহজ ছিল না, ‘পরবর্তী সময়ে আমাকে বলা হয়েছিল, জাহাজে করে আমরা প্রথম যখন কলকাতা থেকে রেঙ্গুন রওনা দিলাম জেটিতে থাকা দিদিমার অপসৃত হওয়া মুখ দেখে মরিয়া হয়ে চিত্কার করে বড় জাহাজটির চলা বন্ধ করতে বলেছিলাম।’

সুতরাং সেখানে পরিবারের সঙ্গে বাল্যবেলার একটা অংশ কাটাতে হয়েছিল। নানান স্মৃতিঘেরা বার্মার প্রতি আকর্ষণ ব্যক্ত করতে গিয়ে অমর্ত্য বলছেন, ‘পুরান ঢাকার মতো, মানিকগঞ্জের মাত্তর মতো, শান্তিনিকেতনের মতো অবশ্যই মান্ডালয় আমার বাড়ি হয়ে ওঠে।’ অবশেষে তিন বছর পর ১৯৩৯ সালে অমর্ত্য সেনের পরিবারের সবাই পুরান ঢাকার উয়ারীর শান্ত সুন্দর পরিবেশের মাঝে ফিরে আসে; তার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল নিয়মিত শান্তিনিকেতনে যাওয়া-আসা।

পাঁচ. ঢাকায় থাকাকালীন তার পুরনো স্মৃতির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাঝেমধ্যে পিতা আশুতোষ সেনের ল্যাবরেটরিতে যাওয়া। টেস্টটিউবে এক তরল পদার্থের সঙ্গে অন্য তরল পদার্থ মেশালে এমন কিছু হয়, যা একেবারেই ভিন্ন এবং অপ্রত্যাশিত—এ দৃশ্য তার মধ্যে বিশাল উত্তেজনা এনে দিত। বাবার সহকারী করিম হাতে-কলমে তাকে এক্সপেরিমেন্টগুলো দেখাতেন এবং তার ডেমনস্ট্রেশন বা প্রতিপাদন সবসময় চমত্কার ছিল। পরবর্তী সময়ে ১২ বছর বয়সে স্মৃতিগুলো ফিরে এল যখন সগর্বে অর্জিত সংস্কৃত জ্ঞান দিয়ে প্রথমবারের মতো খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে সমৃদ্ধিলাভ করা ভারতীয় বস্তুবাদী স্কুল লোকায়তের জীবনের রাসায়নিক ভিত নিয়ে পড়াশোনা করলেন। এমনি করে বয়স বাড়ার সঙ্গে যখন জীবনসংক্রান্ত বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে লাগলেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরির স্মৃতি এবং করিমের ডেমনস্ট্রেশন ঘুরেফিরে তার মনে স্থান করে নিতে থাকে।

অমর্ত্য সেন বার্মার মান্ডালয়ে থাকাকালীন প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে কিছু শিক্ষালাভ করেন, কিন্তু একনিষ্ঠভাবে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ঢাকা ফিরে আসার পর। বাড়ি থেকে অনতিদূরে অবস্থিত লক্ষ্মীবাজারে সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে তার শিক্ষার শুরু। এটা একটা মিশনারি স্কুল, লেখাপড়ায় খুব বিশিষ্ট। হেডমাস্টার আন্তরিকভাবে চাইতেন শুধু উন্নত মানের পাঠদান করা নয়, চূড়ান্ত পরীক্ষায় গ্রেগরিয়ানরা এ অঞ্চলের অন্য ছাত্রদের উজ্জ্বলতায় ছাড়িয়ে যাবে। সম্ভবত সেই সূত্রে ২০০৭ সালে স্কুলের ১২৫তম বার্ষিকী প্রকাশনায় পুরনো দিনের কৃতিত্ব তুলে ধরা হয় এভাবে—‘বারবার আমাদের ছেলেরা এক থেকে দশম অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।’

কিন্তু হায়, উঁচু কৃতিত্ব এবং শক্ত শৃঙ্খলা-সংস্কৃতি অমর্ত্যকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তার কাছে পরিবেশটা শ্বাসরুদ্ধকর মনে হতো এবং হেডমাস্টারের ভাষায় ‘উত্কর্ষ অর্জন’ করতে তিনি মোটেও উৎসাহী ছিলেন না। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর ঢাকা এলে সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলের হেডমাস্টার অমর্ত্য সেনের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেন। সেখানে হেডমাস্টার উল্লেখ করলেন, বর্তমান ছাত্রদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে তিনি গুদামঘর থেকে অমর্ত্য সেনের পরীক্ষার খাতা উঠিয়েছেন, ‘কিন্তু হতাশ হলাম যখন দেখলাম যে আপনার অবস্থান ৩৭ জনের শ্রেণীতে ৩৩তম।’ তারপর তিনি সদয় চিত্তে যোগ করলেন, ‘আমার মনে হয় আপনি একজন ভালো ছাত্র হয়েছেন কেবলমাত্র সেন্ট গ্রেগরিজ ছাড়ার পর।’ অমর্ত্য সেন ভাবলেন, ‘হেডমাস্টার ভুল বলেননি। ভালো ছাত্র বলতে যা বোঝায় তা হয়েছিলাম একমাত্র যখন আমি ভালো অথবা খারাপ ছাত্র এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা ছিল না।’

ছয়. বিদ্যালয়ের বছরগুলোয় অমর্ত্য সেন থেকে থেকে কিন্তু নিয়মিত শান্তিনিকেতনে যেতেন; প্রারম্ভিকভাবে সেখানে পড়াশোনার জন্য যাওয়ার চিন্তা কখনই মাথায় ছিল না। তবে ১৯৪১ সালে জাপানি মিলিটারি বার্মা দখল করলে পরিকল্পনায় পরিবর্তন আসে এবং তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় দাদু-দিদিমার কাছে ওখানকার স্কুলে পড়াশোনা করার জন্য। অবশ্য তার পিতা চেয়েছিলেন অমর্ত্য সেন্ট গ্রেগরিজে পড়বে, যেটা একাডেমিক উত্কর্ষের নিরিখে অপেক্ষাকৃত ভালো, কিন্তু তিনি উত্তরোত্তর ক্রমবর্ধমানভাবে এটাও উপলব্ধি করছিলেন যে জাপানি মিলিটারি কলকাতা ও ঢাকায় বোমা ফেললেও সুদূর শান্তিনিকেতনে বোমা মারার আগ্রহ কোনো বোমারু বিমানের থাকবে না।

সত্যি তা-ই ঘটেছিল। পরবর্তী সময়ে ঢাকা ও কলকাতায় যুদ্ধের বছরগুলোয় নিয়মিত প্রতিরক্ষাসূচক অনুশীলন হতো, চেঁচানো সাইরেনের শব্দ তো ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসতই। ভাগ্যবশত ঢাকায় বোমা পড়েনি, কিন্তু ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার ডক এলাকায় এক সপ্তাহে পাঁচবার বোমা ফেলার ঘটনাও ঘটেছিল।

সুতরাং পিতার যুদ্ধকালীন যুক্তির ফলে শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা শেষ করতে হয় লক্ষণীয়ভাবে একটা প্রগতিশীল  বিদ্যালয়ে। বালক অমর্ত্য সেনের কাছে স্কুলটি খুব ভালো লাগার পেছনে অনেক কারণ কাজ করেছিল। প্রথমত, সেন্ট গ্রেগরিজের চেয়ে এ বিদ্যালয়ের অগ্রাধিকারগুলো শিথিল, কম একাডেমিক। দ্বিতীয়ত, এখানকার শিক্ষায় ভারতীয় নিজ ঐতিহ্য যেমন পাঠ্য ছিল তেমনি অন্যান্য দেশের এবং বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার অবারিত সুযোগ ঘটেছিল। তৃতীয়ত, প্রতিযোগিতামূলক শ্রেষ্ঠতার বিপরীতে শান্তিনিকেতনের শিক্ষা জোর দিত ঔত্সুক্য প্রতিপালনে; বস্তুত গ্রেডস এবং পরীক্ষায় কৃতিত্ব পরিমাপক হিসেবে নিরুৎসাহিত করা হতো এবং সব শেষে যখন তখন ব্যবহারযোগ্য শান্তিনিকেতনের লাইব্রেরির খোলা তাকে এবং যত্রতত্র রাখা বইয়ের স্তূপ মুক্তভাবে ব্যবহার করার সুযোগ অমর্ত্যের জন্য ছিল অপার আনন্দের; আসলেই তিনি পরীক্ষায় ভালো ফল না করাটা পছন্দ করতেন।

অমর্ত্য সেন শান্তিনিকেতন যাওয়ার কিছুদিন পর জাপানিরা ফিরে গেলে যুদ্ধের দামামা মোড় নিল বটে, তবে শান্তিনিকেতনের খুব ভালো লাগার বিদ্যালয় ছেড়ে ফিরে আসতে তিনি রাজি হলেন না। এভাবেই ক্ষণস্থায়ী জন্মস্থান শান্তিনিকেতন খুব দ্রুত তার দীর্ঘস্থায়ী বাড়িতে পরিণত হতে লাগল। ঢাকায় তখনো নিয়মিত আসতে হতো, কারণ তার পিতা শিক্ষকতা করছিলেন এবং তার পরিবার এখানে বাস করতে পেরে খুব খুশি ছিল। বিদ্যালয় খোলা থাকলে শান্তিনিকেতনে আর লম্বা ছুটিতে ঢাকায় বেড়াতে আসা তার কাছে মনে হতো অপূর্ব মিশ্রণ।

সাত. কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগ সেই স্বস্তিতে পানি ঢেলে দিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ভয়ংকর রক্তপাতের কারণে অমর্ত্য সেনের পরিবারে নেমে আসে অবিশ্রাম বিষাদ এবং এর অর্থ দাঁড়াল—তাদের চলে যেতে হবে। ঢাকা সদ্যোজাত পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হলো আর অমর্ত্য সেনের পারিবারিক ঘাঁটি অবস্থান নিল শান্তিনিকেতনে।

ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ এবং সাম্প্রদায়িকতা শুধু রাজপথে রক্ত ঝরায়নি, রক্তক্ষরণ হয়েছিল অমর্ত্য সেনের হূদয়ে। সেদিনের বালক অমর্ত্য সেনের প্রতিক্রিয়া বলে দেয় তিনি ঢাকা তথা বাংলাদেশকে কতখানি ভালোবাসেন:

“আমি শান্তিনিকেতন ভালোবাসতাম কিন্তু যারপরনাই অনুভব করতাম ঢাকার ‘জগত কুটিরে’র অভাব। প্রস্ফীতি যে চম্পা গাছটি উপরতলার বারান্দা অত সুবাসিত করত, সেটা আর আমার জীবনের অংশ হয়ে থাকল না। মনে মনে ভাবতাম ঢাকার পুরনো বন্ধুরা কোথায় এবং এখন কে তাদের সাথে খেলছে এবং আমাদের বাগানের কাঁঠাল ও আমগুলোর অবস্থা কী। আমি একটা পৃথিবী হারালাম। শান্তিনিকেতনে থাকার পরিতৃপ্তি ঢাকা হারানোর বেদনা নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। আমি খুব দ্রুত উপলব্ধি করছিলাম যে একটা নতুন জীবন উপভোগ করা পুরনোটার জন্য তীব্র অনুভূতিকে বাদ দিতে পারে না।”

পাদটীকা

‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,/আমি তোমাদেরই লোক

আর কিছু নয়,/এই হোক শেষ পরিচয়।’

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘পরিচয়’ কবিতা)

উৎস: Amartya Sen (২০২১), ‘Home in the world A Memoir’, Allen Lane.

 

আব্দুল বায়েস: অর্থনীতির অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির খণ্ডকালীন শিক্ষক

Share This Article