অদ্ভুত এক অমানবিক সমাজে আমরা

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:০৩, শনিবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ২২ মাঘ ১৪২৮
ফাইল ফটো
ফাইল ফটো

নিজস্ব প্রতিবেদক: ফেসবুক লাইভে এসে নিজের পরিচয় দিলেন আবু মহসিন খান। গুছিয়ে শান্ত গলায় কথা বলতে শুরু করলেন, ছিলেন সুস্থির। লাইভে থাকা দুজনের উদ্দেশ্যে কথাও বলেছেন। কথার মধ্যে ছোট-বড় বিরতি নিচ্ছিলেন, গলার স্বর বুজে আসছিল মাঝেমধ্যে, ঝাপসা হয়ে আসছিল চোখের চশমার কাচ, কালেমা পড়লেন, বিড়বিড় করে সূরা পাঠ করলেন। ১৬ মিনিটের বেশি সময় কথা বলার পর আবার কালেমা পড়লেন। এরপর হাতে থাকা পিস্তলের ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে মাথার উপর ডান দিকে ঠেকালেন, ট্রিগারে চাপ দিতেই পুরো শরীর ঝাঁকি দিলো, চেয়ারে বসা অবস্থাতেই একদিকে কাত হয়ে পড়লেন। ঠিক সেই সময় বেজে উঠলো টেলিফোন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন চরম অবসাদগ্রস্ত থাকা এই মানুষটি। বুধবার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লাইভে এসে নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল মাথায় ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার এই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। কিন্তু এই আত্মহত্যার ঘটনার পর সঙ্গত কারণেই কিছু প্রশ্ন উঠেছে।

 

টানা ১৬ মিনিট কথা বললেন তিনি, ততক্ষণে থাকে কেন আত্মহত্যা থেকে রক্ষার জন্য কেউ এগিয়ে এলো না? যারা তার লাইভ দেখছিলেন তারা নানা কমেন্ট করছিলেন, তারা কেন ৯৯৯ ফোন করলেন না? আমরা কি একটি বিচ্ছিন্ন একাকীত্বের সমাজে প্রবেশ করেছি, যেখানে যা কিছু ঘটবে আমরা শুধু ফেসবুক লাইভে দেখবো, আমাদের করণীয় কিছুই নেই। শুধু আবু মহসিন খানের এই ঘটনাটা নয়, বাংলাদেশে এখন অমানবিক সমাজের এক প্রতিচ্ছবি দেখা যায় বিভিন্ন ক্ষেত্রেই। বিশেষ করে করোনা প্রকোপ শুরুর পর থেকেই মানুষ যেন ক্রমশ আরো বিচ্ছিন্ন, অমানবিক হয়ে উঠছেন। রাস্তায় যখন একটা দুর্ঘটনা ঘটে আমরা দেখি যে অনেকে যেয়ে সেখানে ছবি তোলার প্রতিযোগিতা করেন, অনেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেন। কিন্তু আক্রান্ত মানুষটিকে তুলে হাসপাতালে পাঠানোর উদ্যোগ দেখা যায়না কারো মধ্যে। যতই আমরা আধুনিক এবং উন্নত হিসেবে নিজেদেরকে প্রমাণ করার চেষ্টা করছি, ততই যেন আমাদের মধ্যে মানবিকবোধ শূন্যতা কমে যাচ্ছে। একই ফ্ল্যাটে বসবাস করেও আমরা একজন আরেকজনকে চিনি না, একজন আরেকজনের খোঁজ রাখেনা।

আবু মহসিন খানের কথাই ধরা যাক। তার ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে, মেয়ে ঢাকায় থাকে। একজন বাবা এরকম সময় কেন একাকীত্বে থাকবেন, কেন তিনি তার নিজের খাবার নিজে রান্না করে খাবেন? তার মেয়ে কি একবার এসে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারতেন না? তার স্ত্রীর কি এতটুকু দায়িত্ব ছিল না যে তিনি ছেলের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া থাকার চেয়ে এসে স্বামীর সঙ্গে থাকবেন? এক ধরনের অবসাদগ্রস্ততা আবু মহসিন খানকে পেয়ে বসেছিল। এরকম অবসাদ কি আমরা সবাই? আমরা যতই কাজের পেছনে ছুটি না কেন, যতই অহর্নিশ পরিশ্রম করি, ঘুরি-ফিরি কিন্তু সবশেষে আমরা একা কি? আমরা জানি? আমরা কি এটা বুঝতে পারি যে, একটা অমানবিক সমাজে আমাদের পাশে কেউ নেই, আমাদের বিপদের রক্ষা করার জন্য কেউ এগিয়ে আসবে না।

আমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেটি একটি মানবিক বাংলাদেশ। যেখানে একজন মানুষ অসুস্থ হলে পাড়া-প্রতিবেশীরা তার জন্য এগিয়ে আসবে, যেখানে একজন বয়স্ক মানুষকে তার সন্তানরা আগলে রাখবে, যেখানে একজন গরিব মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে তার প্রতিবেশীরা বা অন্যরা, যেখানে একজন মানুষ দুর্ঘটনায় পতিত হলে পার্শ্ববর্তী মানুষরা ছুটে আসবে তাকে সহায়তা করার জন্য, তাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য, তার চিকিৎসা করানোর জন্য। কিন্তু আমাদের সমাজ থেকে এ সবগুলো যেন লুপ্ত হতে শুরু করেছে। আমরা এক অচেনা নাগরিক যুগে প্রবেশ করেছি যে নাগরিক যুগে কেউ কাউকে চিনি না। পিতাকে তার সন্তানরা চিনেনা, শিক্ষককে সম্মান করি না, শিক্ষার্থীদের প্রতি ভালোবাসা দেখাই না এবং আমরা নিজের স্বার্থ নিয়েই যেন সারাক্ষণ এক যুদ্ধে লিপ্ত থাকি। কিন্তু এই যুদ্ধের পরিণাম শুধুমাত্র হারা। আবু মহসিন খান কি আমাদের সেই শিক্ষাটাই দিয়ে গেল?

বাংলা ইনসাইডার

Share This Article