‘অ্যাগ্রিকালচার ৪.০’ মানে চতুর্থ প্রজন্মের কৃষি

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১১:৩৪, বুধবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২২, ৫ মাঘ ১৪২৮
শাইখ সিরাজ
শাইখ সিরাজ

শাইখ সিরাজ
সম্প্রতি ভারতীয় একটি কৃষিবিষয়ক জার্নালের শিরোনাম ‘অ্যাগ্রিকালচার ৪.০’ দেখে চোখ আটকে গেল। প্রযুক্তির কৃষিকে এভাবেই সংজ্ঞায়িত করতে চাইছে আন্তর্জাতিক অ্যাগ্রোটেক কোম্পানিগুলো। বিষয়টা সত্যিই কৌতূহলোদ্দীপক। তরুণদের আকৃষ্ট করতে এমন শিরোনাম চমৎকার। কিংবা বলা যায়, তরুণদের অংশগ্রহণের ফলেই কৃষিকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব হচ্ছে। ‘অ্যাগ্রিকালচার ৪.০’ মানে চতুর্থ প্রজন্মের কৃষি। শিরোনামটি একই সঙ্গে আধুনিক কৃষিকে যেমন উপস্থাপন করে, সেই সঙ্গে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কৃষি যে খুব দূর অগ্রসর হয়নি, সে কথাও বলা যায়। যেহেতু কৃষিই আমাদের আদিম পেশা। শিল্পবিপ্লবের পর কারখানাভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার দিকেই মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়। বলা চলে, কৃষি একরকম অবহেলার শিকার হয়। পৃথিবী এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে হাঁটছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কৃষি কার্যক্রম দেখার সুযোগ হয়েছে। আমি একাধিক লেখায় চতুর্থ প্রজন্মের কৃষি ব্যবস্থাপনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি কৃষির বিবর্তনধারা তুলে ধরতে, বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষির পটপরিবর্তন, যা আমার খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে।

বলা ভালো, উন্নত বিশ্ব যখন ‘অ্যাগ্রিকালচার ৪.০’ নিয়ে অগ্রসরমাণ, প্রকৃত প্রস্তাবে আমরা এখনো পুরোপুরি তৃতীয় প্রজন্মের কৃষিতেও আপডেট হতে পারিনি। তবে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আমাদের কৃষি ব্যবস্থাপনাকে হালনাগাদের বিকল্প নেই।

আমরা একটু দৃষ্টি দিতে পারি উন্নত বিশ্বের কৃষি পরিকল্পনার দিকে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার বিবেচনায় ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৬৭% লোক চলে আসবে নগর এলাকায়। একদিকে নগর ধেয়ে যাচ্ছে গ্রামাঞ্চলের দিকে। গ্রামীণ জীবন ও সমাজ নগরায়ণের প্রভাবে পাল্টে যাচ্ছে। অন্যদিকে অব্যাহত রয়েছে নগরমুখী মানুষের স্রোত। আমাদের ঢাকা শহরের বাস্তবতাই জানান দেয় সে কথা। প্রশ্ন হলো, নগর যদি মানুষের এই চাপ সামাল দিতেও পারে, তাহলে খাদ্য জোগান নিশ্চিত হবে কীভাবে? পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো এ ভাবনায় যথেষ্টই অগ্রসর। তার মানে নগরের মানুষও কৃষি থেকে পিছিয়ে নেই। আপনাদের অনেকেরই হয়তো মনে আছে নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে ‘ছাদে বাগান’ গড়ার একটি অভিযান শুরু করেছিলাম। আবার হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের পক্ষ থেকে নগরকৃষির উদ্বুদ্ধকরণ অভিযান শুরু করেছি বেশ আগে। বিশেষ করে নগরের মানুষকে কৃষিতে অনুরক্ত করে তোলা ও প্রজন্মের কাছে কৃষির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার প্রচেষ্টা থেকেই এসব উদ্যোগ। আমরা কখনোই গ্রামের মানুষের, বিশেষ করে কৃষকের সমস্যাটি তেমনভাবে অনুধাবন করতে পারি না। এর প্রধান কারণ, নীতিনির্ধারক সবাই মূলত শহরে বসবাস করেন। আর একটা বিষয় আমরা আমলে নিচ্ছি না। সেটা হলো, গ্রামগুলো ধীরে ধীরে শহরে পরিণত হবে। আগেই বলেছি, আগামীর কৃষি মানেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল কৃষি। এক অর্থে নগরকৃষি।

প্রশ্ন হচ্ছে, আগামী প্রজন্মের কৃষির জন্য আমরা কীভাবে প্রস্তুতি নেব?

আমাদের দেশে খুব শিগগির চালু হতে যাচ্ছে ফাইভ-জি ইন্টারনেট। এটা আশার কথা। উন্নত বিশ্ব ফাইভ-জি সুবিধা কাজে লাগিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য জনশক্তি প্রস্তুত করেছে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা ভিন্ন। সত্যিকার অর্থে আমরা ফোর-জি ইন্টারনেটের সুবিধাই ঠিকঠাকমতো পাই না। খোদ ঢাকাতেই গাড়িতে বসে ইউটিউবের ভিডিও স্ট্রিমিং করতে অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়, সেখানে দেশের অন্য অঞ্চল, শহর বা গ্রামের অবস্থা কী হতে পারে, তা সহজে অনুমেয়।

চীনের কথা যদি বলি, বছর দুয়েক আগে চীনে দেখে এসেছি তারা শিশু-কিশোরদের শিক্ষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিকসকে একীভূত করেছে। একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রযুক্তির শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছে। পাশাপাশি আগামীর কৃষির জন্য মানবসম্পদ তৈরি করছে তারা। শুধু চীন নয়, যে দেশ যত উন্নত সে দেশ তত বেশি মনোযোগী এ বিষয়ে।

তবে আশার কথা হচ্ছে গত ১৩ বছরে সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের ফলে আইসিটি খাতে আমরা অনেকদূর হেঁটেছি। প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার গঠনের ফলে একটা চমৎকার অবকাঠামো তৈরি হয়ে আছে। শুনেছি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলো এখন ফাইবার অপটিক্যাল তারের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হচ্ছে; স্কুল-কলেজগুলোতে ডিজিটাল ল্যাব হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে নানান রকম ইন্টারঅ্যাকটিভ কনটেন্ট। ডিজিটাল বাংলাদেশের যে প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে, সেখানে কৃষককে পরিবর্তিত প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে প্রয়োজন কৃষিকে মাথায় রেখে নতুন উদ্যোগের।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কৃষিবিষয়ক উচ্চশিক্ষার কারিকুলাম আপডেট করতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কৃষি তো বটেই, আগামীর কৃষির রূপরেখা আঁকতে সময়োপযোগী কারিকুলাম তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি গবেষণা হতে হবে মাঠপর্যায়ের প্রায়োগিকতা চিন্তা করে। গবেষণা ও উদ্ভাবনকে সামনে রেখেই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে।

ঠিক এই মুহূর্তে নতুন প্রজন্ম কী ভাবছে? অর্থাৎ কৃষি নিয়ে তাদের ভাবনা কী? সুযোগ পেলেই আমি তরুণদের কথা শুনতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, তরুণদের ভাবনাচিন্তার জগৎটা অন্য রকম। তাদের স্বপ্নের যেমন সীমাবদ্ধতা নেই, তেমনি অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার ইচ্ছাশক্তিরও কোনো ঘাটতি নেই। এখনকার তরুণ স্বভাবতই প্রযুক্তির বিষয়ে খুব সচেতন ও আগ্রহী। এই তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আগামীর কৃষির একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে। যারা বিশ্বকৃষির প্রতি রাখবে সচেতন দৃষ্টি আর আমাদের কৃষিকে করবে গতিশীল।

শুধু খাদ্যের তাগিদে কৃষি—এই চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কৃষিই হবে আগামীর কর্মসংস্থানের বড় খাত—এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস না করলে এই খাতকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে কৃষি এরই মধ্যে প্রবেশ করেছে শিল্পের ফর্মে। উৎপাদন ব্যবস্থায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। ঊর্ধ্বমুখী কৃষি ব্যবস্থাপনায় অল্প জমিতে বেশি উৎপাদন হচ্ছে। অর্গানিক উপায়ে বেশি উৎপাদনের জন্য প্রযুক্তির কৃষির বিকল্প নেই। প্রযুক্তির বিকাশ নিশ্চিত করতে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন কৃষক প্রশিক্ষণ। সে ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। এ বিষয়গুলো নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিতে পারে।

নতুন প্রজন্মের কৃষির জন্য প্রজন্মকে তৈরি করতে হবে। তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়াতে নিতে হবে উদ্যোগ, তৈরি করতে হবে পরিবেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে গোটা পৃথিবীতেই আজ যে চ্যালেঞ্জ দানা বাঁধছে, তা হচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য। যে হিসাবেই আমরা ২০৩০-এর মধ্যে পৃথিবীকে ক্ষুধামুক্ত করার চিন্তা করি না কেন, পরিকল্পিত নগরায়ণ, বিশুদ্ধ নিশ্বাসের ব্যবস্থা আর কৃষকসহ সব মহলের সমান অংশীদারত্বের ভিত্তিতে একটি বাস্তবমুখী কৃষি ও আবাসন পরিকল্পনা না করতে পারলে এই স্বপ্ন পূরণ করা কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই নতুন প্রজন্মের ভাবনাগুলোকে মূল্যায়ন করার যৌক্তিকতা রয়েছে। আশা করা যায়, এই দৃষ্টান্তগুলোর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে সময়োপযোগী গবেষণাসহ নানামুখী কাজ অব্যাহত থাকবে, অর্জিত হবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা।

লেখক: কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই 

সূত্র: আজকের পত্রিকা

Share This Article