বাংলা থেকে দেশ-দেশান্তরে: ভাষার প্রতি শ্রদ্ধার স্বীকৃতি এলো যে পথে

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ০৬:০৭, মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৮ ফাল্গুন ১৪২৯

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ। সেদিন মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত ও শফিউররা। পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষার জন্য এত রক্ত আর কোন জাতি দেয়নি। এই ত্যাগ যেন বৃথা না যায় কখনও, সবাই যেন ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, এ জন্য বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষাকে দেওয়া হয়েছিলো স্বীকৃতি। এর হাত ধরে বর্তমানে ইউনেস্কোভুক্ত ১৮৮টি দেশ একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেব পালন করে আসছে।

 

শুরুতে ভাষার প্রতি শ্রদ্ধার এ স্বীকৃতি পাওয়ার পথটি এতোটা সহজ ছিল না। পথের পরতে পরতে ছিল বাধা। তবে সব বাধা উপেক্ষা করে এ কাজটি সহজ করেছিলেন রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম নামের দুই বাংলাদেশি বংশদ্ভুত। কানাডার ভ্যানকুভার থেকে তারাই সর্বপ্রথম এ দিবসটির বীজ বপন করেছিলেন।

২১ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করার আগে, এই দিনটি মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দাবি উঠে, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও এ দাবি তোলা হয়। এ রকম আরও কিছু ব্যক্তিগত ও বিচ্ছিন্ন উদ্যোগের কথা আমরা জানতে পারি।

১৯৯৮ সালের ৯ই জানুয়ারী বাংলা ভাষার স্বীকৃতি পেতে রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। সে সময় এ চিঠিটি সেক্রেটারী জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের নজরে আসলে তিনি রফিককে অনুরোধ করেন, তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন। কারণ এখানে স্ব স্ব দেশের মতামতটা মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। সেই উপদেশ অনুযায়ী রফিক তার সহযোদ্ধা আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে “এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দ্যা ওর্য়াল্ড”(Mother Language Lovers of the World)- নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান।  

সংগঠনের পক্ষ হতে  প্রথমে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ নামে একটি দিবস ঘোষণার প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়।   প্রস্তাবে বলা হয়, ‘বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সেটা ছিল তাদের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। আজকের পৃথিবীতেও অনেক জাতি-গোষ্ঠীর ভাষাও একই সমস্যা ও বিপদের মধ্যে আছে। কাজেই মাতৃভাষা দিবসের দাবিটি খুবই ন্যায়সংগত।

এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন সাত জাতি ও সাত ভাষার ১০ জন সদস্য। এরপর বিষয়টি যায় জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি-বিষয়ক সংগঠন ইউনেসকোর কাছে। ১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ ইউনেসকো সদর দপ্তরের ভাষা বিভাগের কর্মকর্তা আন্না মারিয়া  একটি চিঠিতে জানান যে ‘২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার অনুরোধটি বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। ইউনেসকোর পরিচালনা পরিষদের কোনো সদস্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে সভায় তোলার কথাও জানান তিনি।

এদিকে, ইউনেসকো সাধারণ পরিষদে বিষয়টি আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হলে কয়েকটি সদস্য দেশের পক্ষে প্রস্তাব পেশ করা জরুরি। তখন হাতে সময় ছিল খুবই কম। কেননা অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সাধারণ পরিষদের সভা বসবে। তখনই কানাডা থেকে রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিষয়টি রাষ্ট্রের জন্য গর্বের বিষয় মনে করে মন্ত্রণালয় অতি দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর অফিসে অনুমতি চেয়ে নোট পাঠায়। বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে স্বল্প সময়ের মধ্যে সব ধরনের জটিলতা উপেক্ষা করে নথি অনুমোদনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ছাড়াই ইউনেসকোর সদর দপ্তরে প্রস্তাবটি পাঠিয়ে দেন সরাসরি। সে সময় জনমত তৈরিতে ইউনেস্কোভূক্ত দেশগুলোর সাথে যোগাযোগও করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

অতপর ইউনেস্কোর টেকনিক্যাল কমিটি কমিশন-২এ বাংলাদেশের প্রস্তাবটি পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী উত্থাপিত হয় ১৯৯৯ সালের  ১২ নভেম্বর। ১৮৮ টি দেশ এতে সাথে সাথেই সমর্থন জানায়। কোন দেশই এর বিরোধিতা করেনি, এমনকি খোদ পাকিস্তানও নয়। সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গৃহীত হয় ইউনেস্কোর সভায়।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালের ৪ জানুয়ারি ইউনেস্কোর মহাপরিচালক কাইচিরো মাটসুরা এক চিঠিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিবছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। এভাবেই বাংলাদেশের একুশে ফেব্রুয়ারি একটি আন্তর্জাতিক দিনে পরিণত হয়।বাংলার মাটি থেকে দেশ- দেশান্তরে চলে যায় বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাসের তথ্য।

উল্লেখ্য, ইউনেস্কো শুধু মাতৃভাষার জন্য বাঙালির সংগ্রাম ও আত্মত্যাগকেই স্বীকৃতি দেয়নি, অমর একুশের শহীদদের আত্মদান থেকে উৎসারিত স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জনকেও মর্যাদা দিয়েছে। জাতি হিসেবে আমাদের পৃথিবীর বুকে মহিমান্বিত করেছে। সর্বসাকুল্যে বিশ্বের ১৯০টি দেশে এখন প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপিত হচ্ছে।

Share This Article