এলসি খোলায় অনিয়মের কারণে জরিমানা গুনল তিন ব্যাংক
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে ৩ মিলিয়ন বা ৩০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের এলসি বা ঋণপত্র খোলার তথ্য ২৪ ঘণ্টা আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হয়। কিন্তু এই তিন ব্যংক ৩০ কোটি ডলারের বেশি এলসি খুলেও এ তথ্য জানায়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য ও আন্ডার ইনভয়েসিং করে এলসি বা ঋণপত্র খুলেছে সরকারি-বেসরকারি খাতের তিন ব্যাংক। নির্দেশনা অমান্যের দায়ে ব্যাংক তিনটিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক তিনটির মধ্যে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সোনালী ব্যাংক। অপর দুই ব্যাংক ইসলামি ধারার। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শেয়ার বিজকে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এলসি খোলার ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। তিনটি ব্যাংক নির্দেশনা অমান্য করে এলসি খুলেছে। তাই আইন অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে জরিমানা করা হয়েছে। সংকট মোকাবিলায় এসব পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে ৩ মিলিয়ন বা ৩০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের এলসি বা ঋণপত্র খোলার তথ্য ২৪ ঘণ্টা আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি সোনালী ব্যাংকের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (শেরাটন) শাখা ও ইসলামি ধারার একটি ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা ৩ মিলিয়ন বা ৩০ কোটি ডলারের বেশি এলসি বা ঋণপত্র খুলে। দুই শাখার এলসি বা ঋণপত্র খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে তথ্য জানায়নি। এজন্য ব্যাংক দুইটির শাখা উপ-মহাব্যবস্থাপককে (ডিজিএম) এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়।
এছাড়া ইসলামি ধারার অপর একটি ব্যাংকের সাতক্ষীরা শাখা অন্ডার ইনভয়েসিং (পণ্যের দাম কম দেখিয়ে ) এলসি বা ঋণপত্র খুলেছে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে এলে ওই শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপকে একইভাবে জরিমানা করা হয়। ব্যাংক তিনটির জরিমানার টাকা তাদের প্রধান হিসাব থেকে কেটে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ বিষয়ে জানতে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকতা আফজাল করিমকে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেনি। পরে মোবাইল ফোনে মেসেজ করা হলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (শেরাটন) শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপক আনিস শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী সবসময় এলসি খোলা হয়। সরকারি এলসি খোলার ক্ষেত্রে জানানোর নিয়ম নেই। যে প্রতিষ্ঠানের এলসি খোলা হয়েছে, তাতে সরকারের অর্ধেক শেয়ার রয়েছে। তাই এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে অবহিত করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকে আমাদের ব্যাখ্যা জানিয়ে দিয়েছি।
জানা যায়, দেশে ডলার সংকট শুরু হলে বাংলাদেশ ব্যাংক এলসি খোলায় কিছু নির্দেশনা দেয়। কারণ আগে ব্যাংকগুলো অনেক অপ্রয়োজনীয় এলসি খুলত। তাই অপ্রয়োজনীয় এলসি কমাতে ব্যাংকগুলোকে প্রথমে ৫০ লাখ ডলারের বেশি এলসি খুলতে বাংলাদেশ ব্যাংকে জানাতে নির্দেশ দেয়। ওই সময়ে পাঁচ প্রতিষ্ঠানের সাড়ে চার কোটি ডলারের ঋণপত্র আটকে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। অতীতে ঋণপত্র আটকে দেয়ার ঘটনা শোনা যায়নি। তবে সংকট আরও গভীর হলে তা কমিয়ে ৩০ লাখ ডলারে আনা হয়। এখন ৩০ লাখ ডলারের বেশি ঋণপত্র খুলতে হলে ২৪ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে জানানোর নির্দেশনা রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকগুলো যথাসময়ে এলসি খোলার তথ্য জানায়নি। এজন্য তাদের নিয়ম অনুযায়ী জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার ফলে অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটা সতর্কতা সৃষ্টি হবে। ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং যাতে না হয়, এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে বিভিন্ন পণ্যে ২০ থেকে ২০০ শতাংশ ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়েছে। বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২১-২২ প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব কথা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য বাড়িয়ে দেখিয়ে কোনো কোনো পণ্য আমদানি করা হয়েছে। নজরদারি জোরদার করার ফলে তা হচ্ছে না। এটা ঠেকানো গেছে। এখন কর ফাঁকি দিতে মূল্য কম দেখিয়ে যা আমদানি হচ্ছে, তা নিয়ে কাজ করতে হবে। এই তালিকায় রয়েছে গাড়ি। এদিকেও তদারকি জোরদার করা হচ্ছে।
গত রোববার মুদ্রানীতি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিং (পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে) অর্থ পাচার হচ্ছে বলে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, দেশ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ পাচার হয়েছে। সাধারণত দুভাবে সম্পদ পাচার হয়। আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং। এতে একদিকে দেশের টাকা বিদেশে চলে গেছে। অন্যদিকে কর ফাঁকি দেয়া হয়েছে। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে চার ভাগের এক ভাগ দামে এলসি খুলেছেন অনেক গ্রাহক। কাজটা করেছেন ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য। তবে বাকি তিন ভাগ অর্থ নিশ্চয়ই হুন্ডির মাধ্যমে পরিশোধ করেছেন। বিষয়গুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে। এরই মধ্যে অনেকাংশে এই কাজগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও কমবে বলে আশা ব্যক্ত করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।