৪০০ কোটি টাকার মদ বিক্রি করেছে কেরু

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:২২, শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২২, ৯ পৌষ ১৪২৯

জহির রায়হান সোহাগ, চুয়াডাঙ্গা

এ বছর শুধু মদ বিক্রি থেকে কেরুর আয় হয়েছে ৩৬৭ কোটি টাকা। লাভ হয়েছে ১০০ কোটি টাকারও বেশি। গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় ১০ লাখ প্রুফ লিটার বেশি মদ বিক্রি করেছে কেরু। বিপরিতে প্রতি বছরের মতো এবারও চিনি ইউনিটে বড় ধরণের লোকসান হয়েছে কেরুতে যা প্রায় ৫০ কোটি টাকা।

 

চিনিখাতে টানা লোকসান হলেও চলতি বছর মদের বেচাবিক্রি ও মুনাফায় রেকর্ড করেছে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। দেশে বিদেশি মদের আমদানি কমে যাওয়ায় এই প্রথমবারের মতো বিভিন্ন ইউনিট থেকে মোট বেচাবিক্রি ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় মদ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠানটির, যা প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

এ বছর শুধু ডিস্টিলারি ইউনিট বা মদ বিক্রি থেকে কেরুর আয় হয়েছে ৩৬৭ কোটি টাকা। লাভ হয়েছে ১০০ কোটি টাকারও বেশি। গত বছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ১০ লাখ প্রুফ লিটার বেশি মদ বিক্রি করেছে কেরু।

বিপরিতে প্রতি বছরের মতো এবারও চিনি ইউনিটে বড় ধরণের লোকসান হয়েছে কেরুতে যা প্রায় ৫০ কোটি টাকা।

তবে প্রতিষ্ঠানটি মদের মতো চিনিতেও লাভজনক হয়ে উঠতে চায়। চলতি মৌসুমে চিনিখাতে লোকসান কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এটি।

নতুন অর্থবছরের আখ মাড়াই মৌসুম শুরু করেছে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। এবার প্রায় ৪ হাজার টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৮৩ বছরেরও বেশি পুরনো এ প্রতিষ্ঠানটি।

 

৪০০ কোটি টাকার মদ বিক্রি করেছে কেরু

 

শুক্রবার বিকেল ৫টায় আনুষ্ঠানিকভাবে এ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনিশিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান অপু। চলতি মৌসুমে ৫৩ মাড়াই কার্যদিবসে ৬২ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৩ হাজার ৮৪০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কেরু কর্তৃপক্ষ।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন, চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাফফুজুর রহমান মনজু, দামুড়হুদা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলী মুনছুর বাবু, দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা বেগম প্রমুখ।

আরিফুর রহমান অপু জানান, আখের উৎপাদন বৃদ্ধিতে আখচাষীদের উদ্বুদ্ধ করতে এক দফায় আখের দাম বাড়ানে হয়েছে। আগামী মৌসুমে আবারও আখের দাম বাড়ানো হবে। এতে কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ ফিরবে।

দেশের চিনির বাজারে চাহিদা নিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশে যে পরিমাণ চিনির চাহিদা রয়েছে তা দেশের চিনিকলগুলো পূরণ করতে পারে না। তাই আমদানির ওপর নির্ভর থাকতে হয়। যদি আখচাষ বাড়ে, তাহলে সে চাহিদা অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব হবে।’

তিনি বলেন, ‘চিনিখাতটি লাভজনক পর্যায়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। ডিস্টিলারির মতো কেরুর সবখাতকে লাভজনক করা হবে। আখচাষে আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে কৃষকদের। আখচাষীদের সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। কৃষদের সঙ্গে সভা-সমাবেশ, উঠান বৈঠক চলমান রয়েছে।’

চিনিকল সূত্রে জানা গেছে, এবার ৪ হাজার ২৩০ একর জমিতে আখ রয়েছে। যার মধ্যে কেরুর নিজস্ব জমির পরিমাণ ১ হাজার ৫০ একর। বাকি ৩ হাজার ১৮০ একর কৃষকদের জমিতে আখ চাষ করা হয়েছে। আখের সঠিক পরিচর্যা, আধুনিক পদ্ধতিতে আখচাষ ও মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ কর্মকর্তাদের সার্বিক দেখভালের কারণে এবার আখের ফলন ভালো হয়েছে। যে কারণে ধারণা করা হচ্ছে, আখ মাড়াইসহ চিনি উৎপাদনের লক্ষমাত্রা অর্জন সক্ষম হবে।

 

৪০০ কোটি টাকার মদ বিক্রি করেছে কেরু

অপরদিকে, ২০২২-২৩ আখ রোপণ মৌসুমে আনুষ্ঠানিকভাবে আখ রোপণ শুরু করা হয় গত ১ সেপ্টেম্বর। এ বছর ৭ হাজার জমিতে আখ রোপনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৭০০ একর জমিতে আখ রোপন সম্পন্ন হয়েছে। তবে, গতবারের তুলনায় এবার আখের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। মিল গেটে ১৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮০ টাকা। এ ছাড়া আখক্রয় কেন্দ্রগুলোতে ১৩৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭৬ টাকা।

কেরুর দেয়া তথ্য মতে, এই প্রথম ডিস্টিলারি ইউনিট থেকে ১০০ কোটি টাকারও বেশি মুনাফা করেছে কেরু। গত বছর এই ইউনিট থেকে লাভ ছিল প্রায় ৯০ কোটি টাকা।

২০২১-২২ অর্থবছরে চিনি ইউনিটে লোকসান সমন্বয়ের পরও কোম্পানির নিট মুনাফা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৭০ কোটি টাকা, যা গত ২০২০-২১ অর্থ বছরে ছিল ১৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।

দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ সালে অন্য বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশেরও বেশি বাড়ে কেরুর উৎপাদিত মদের বেচাবিক্রি। গত বছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৩০ শতাংশ বেড়েছে কেরুর মদের চাহিদা। অর্থাৎ, প্রায় ১০ লাখ প্রুফ লিটার বেশি মদ বিক্রি করেছে কেরু। প্রতি মাসে গড়ে ১২ থেকে ১৩ হাজার কেস কেরুর উৎপাদিত মদ বিক্রি হয়ে থাকে। উৎপাদনও সে অনুযায়ী করা হয়।

কেরু অ্যান্ড কোং ১৭৫ মিলিলিটার, ৩৭৫ মিলিলিটার ও ৭৫০ মিলিলিটারের বোতলে মদ বাজারজাত করে থাকে। একটি কেসে ৭৫০ মিলিলিটারের ১২টি, ৩৭৫ মিলিলিটারের ২৪টি ও ১৭৫ মিলিলিটারের ৪৮টি মদের বোতল থাকে।

কেরুতে রয়েছে মদের ৯টি ব্র্যান্ড। ব্র্যান্ডগুলো হচ্ছে ইয়েলো লেবেল মল্টেড হুইস্কি, গোল্ড রিবন জিন, ফাইন ব্র্যান্ডি, চেরি ব্র্যান্ডি, ইম্পেরিয়াল হুইস্কি, অরেঞ্জ কুরাকাও, জারিনা ভদকা, রোসা রাম ও ওল্ড রাম।

কেরু সূত্র আরও জানায়, দেশে বিদেশি মদের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় কেরুর মদের চাহিদা বেড়েছে কয়েক গুণ। গত বছর শুল্ক ফাঁকি রোধে মদ আমদানিতে নজরদারি বাড়ায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে বৈধপথে হ্রাস পায় মদ আমদানি। তাই বিদেশি মদের সংকট দেখা দেয় দেশের অনুমোদিত বারগুলোতে। তারপর থেকে ক্রমেই বৃদ্ধি পায় দেশে উৎপাদিত মদের চাহিদা। সেই চাহিদা পূরণে উৎপাদন বাড়ায় কেরু। এতে করে কেরুর উৎপাদিত মদ বিক্রি বাড়ার সাথে বেড়েছে মুনাফার পরিমাণ।

৯টি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের আওতায় আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য প্রস্তুতকৃত ১০ লাখ ৮০ হাজার প্রুফ লিটার মদ, ২৬ লাখ লিটার দেশি স্পিরিট ও ৮ লাখ লিটার ডিনেচার্ড স্পিরিট উৎপাদন করা হয় কেরুতে। মদের পাশাপাশি ভিনেগার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সার, চিনি ও গুড়ের মতো অন্যান্য পণ্যও উৎপাদন করে থাকে কেরু।

 

৪০০ কোটি টাকার মদ বিক্রি করেছে কেরু

 

 

 

কেরুর ডিস্টিলারি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ফিদাহ হাসান বাদশা জানান, বর্তমানে কেরুতে চিনি, ডিস্টিলারি, ফার্মাসিউটিক্যালস, বাণিজ্যিক খামার, আকন্দবাড়িয়া খামার (পরীক্ষামূলক) এবং জৈব সার এই ছয়টি ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ডিস্টিলারি ও জৈব সার ইউনিটই লাভজনক। আখের রসের গুড় থেকে অ্যালকোহল ও বিভিন্ন ধরনের স্পিরিট তৈরি করে থাকে কোম্পানিটি, যা চিনি উৎপাদনের উপজাত।

চিনি উৎপাদনের জন্য আখের রস আহরণের পর তিনটি উপজাত পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে গুড়, ব্যাগাস ও প্রেস মাড। মদ বা অ্যালকোহল উৎপাদনের প্রধান উপাদান হল গুড়। গুড়ের সাথে ইস্ট প্রক্রিয়াকরণের পরে তৈরি করা হয় অ্যালকোহল।

দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশাররফ হোসেন জানান, ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়নের লক্ষ্যে ১০২ কোটি ২১ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। প্রকল্পটি শেষ হলে উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় করা হবে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলে উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ হবে।

কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ঢাকা, চট্টগ্রাম ও চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনায় তিনটি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এ ছাড়া পাবনার রূপপুর, কক্সবাজার ও পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় একটি করে বিক্রয় কেন্দ্র এবং রাজশাহী ও রামুতে একটি করে ওয়্যারহাউস নির্মাণের মাধ্যমে বাজার সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

বর্তমানে সারাদেশে কেরুর ১৩টি ওয়্যারহাউস ও তিনটি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে।এরই মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কেরুর দুটি নতুন বিক্রয়কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে। বিক্রয়কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করার জন্য পর্যটন করপোরেশনের সাথে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করার কথা রয়েছে।

কেরুর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও জানান, শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধার অপব্যবহার রোধে তৈরি একটি সফটওয়্যার ব্যবহার নিয়ে রেষারেষি হয় বাংলাদেশ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বেসরকারি কূটনৈতিক বন্ডেড ওয়্যারহাউসগুলোর মধ্যে। এই কারণে কমে গেছে বিদেশি মদের সরবরাহ। এরই জেরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে দেশীয় ব্র্যান্ড কেরু অ্যান্ড কোম্পানির মদের চাহিদা। সারা দেশে ১৩টি ওয়্যারহাউস ও তিনটি বিক্রয়কেন্দ্র থেকে ইতিমধ্যে বাড়তি চাহিদা পেয়েছি। এর মধ্যে ঢাকা ও শ্রীমঙ্গল ওয়্যারহাউসের চাহিদা সব থেকে বেশি।

তিনি জানান, বর্তমানে দেশে মদের চাহিদা পূরণে কোম্পানির বিদ্যমান ক্যাপাসিটির ব্যবহার বেড়েছে। এখনও একটি বড় অংশ অব্যহৃত রয়েছে। এরপরও চাহিদা বাড়লে তা পূরণে মদ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

এর মধ্যে কেরুর দ্বিতীয় একটি ইউনিট নির্মাণের কথা জানান শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। দেশে অ্যালকোহলের চাহিদা মেটাতে বিয়ার তৈরির লক্ষ্যে দ্বিতীয় ইউনিটটি স্থাপন করা হবে বলে কেরুর একটি সূত্রে জানা গেছে। ইতিমধ্যে ওই বিষয়ে আগ্রহও দেখিয়েছে বেশ কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠান।

 

 

বিষয়ঃ বাংলাদেশ

Share This Article