ঋণ না নিয়েও খেলাপি

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ দুপুর ১২:১৫, বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪২৯

রাজধানীর ধানমন্ডির বাসিন্দা ফেরদৌসী বেগম স্থানীয় জুনিয়র ল্যাবরেটরি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। যিনি বড় ধরনের আর্থিক প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তার অজান্তেই তার স্বাক্ষর জাল করে চার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকার ঋণ নিয়ে তা হাতিয়ে নিয়েছেন একই স্কুলের চেয়ারম্যান নাজমুল হাসান। ঋণ না নিয়েও তা পরিশোধের জন্য এখন প্রতিনিয়ত হয়রানি হচ্ছেন ফেরদৌসী বেগম।

ধানমন্ডি জুনিয়র ল্যাবরেটরি স্কুলের চেয়ারম্যান ছিলেন নাজমুল হাসান, যিনি অ্যাপার্টমেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামের একটি ডেভেলপার কোম্পানিরও মালিক। স্কুলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের সুবিধা নিয়ে তিনি স্কুলের ফাইল থেকে ফেরদৌসী বেগমের জাতীয় পরিচয়পত্রসহ জরুরি কাগজের কপি করে নেন। সেই কাগজ ব্যবহার করে তিনটি বেসরকারি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা ঋণ নেন। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ফেরদৌসী বেগমের স্বাক্ষরও জাল করেন। যদিও ঋণ নেওয়ার কোনো আবেদন ফেরদৌসী বেগম করেননি। এমনকি ব্যাংকগুলোতে সশরীরে উপস্থিতও ছিলেন না। কিন্তু ব্যাংক কর্মকর্তার সহায়তায় তার নামে ঋণ নেওয়ায় ফেঁসে গেছেন এ শিক্ষিকা।

সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ফেরদৌসী বেগমের স্বাক্ষর নকল করে নাজমুল হাসান এ ঋণ নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঋণ অনুমোদনের আগে ফেরদৌসী বেগমের সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়নি, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার স্পষ্ট লঙ্ঘন।

জানা যায়, ২০১৬ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের নবাবপুর শাখা ফেরদৌসী বেগমের নামে রাজধানীর উত্তরার মডেল টাউনে অবস্থিত ‘নার্গিস ভিলা’র ৭-এ ও ৭-বি ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ঋণ অনুমোদন করে। এ ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা ব্যাংকের শাখায় উপস্থিত হননি। এমনকি তিনি ঋণের আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেছেন কি না তাও যাচাই করেনি ব্যাংক। ফেরদৌসী বেগমের নামের এ ঋণ পুরোটাই ভোগ করেছেন নাজমুল হাসান। যে ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য ব্র্যাক ব্যাংক ঋণ অনুমোদন করেছে ওই ফ্ল্যাটগুলো আগে থেকেই তার ডেভেলপার কোম্পানির ঋণের বিপরীতে পদ্মা ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ রাখা। অন্য ব্যাংকের মর্টগেজ দেওয়া সম্পদের বিপরীতেই ব্র্যাক ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ ঋণ অনুমোদন দিয়েছে। যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালাবিরোধী।


একইভাবে ব্যাংক এশিয়ার কাজীপাড়া শাখা ও ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের কারওয়ান বাজার শাখা ঋণ দিয়েছে। ব্যাংক এশিয়ার কাজীপাড়া শাখা ওই শিক্ষিকার নামে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার এবং ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট দেয় ১ কোটি টাকা ঋণ। কোনো প্রতিষ্ঠানই ফেরদৌসী বেগমের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না করেই নাজমুল হাসানের কাছে ঋণের টাকা হস্তান্তর করেছে। এ ছাড়াও অন্য আরও একটি ব্যাংকের শাখা ফেরদৌসী বেগমের নামে আরও ১ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। অর্থাৎ এ চার ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফেরদৌসী বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ না করেই প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে যা তুলেছেন নাজমুল হাসান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, জালিয়াতির এসব ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নরের পরিচয় ব্যবহার করেছেন নাজমুল হাসান। যে কারণে ব্যাংকগুলো ঋণগ্রহীতার বিষয়টি খতিয়ে দেখেনি।

পরবর্তীকালে জালিয়াতির এসব ঋণ দীর্ঘদিন ধরে পরিশোধ না করায় তিন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফেরদৌসী বেগমের নামে মামলা করে। এরপরই তিনি জানতে পারেন তার নামে তিন ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। বিষয়টি জানার পর তিনি ব্যাংকগুলোতে যোগাযোগ করলেও তারা কোনো ধরনের সাড়া দেয়নি। পরে তিনি থানায় নাজমুল হাসানের নামে প্রতারণার মামলা করেন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিষয়টির প্রতিকার চেয়ে আবেদন জানান।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ টিম বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে নামলে নাজমুল হাসান একটি ব্যাংকের শাখায় পাঠানো এক পত্রের মাধ্যমে স্বীকার করেন যে, তিনি ফেরদৌসী বেগম ও তার পরিবারের সদস্যদের স্বাক্ষর, ভিজিটিং কার্ড, ছবি ও এনআইডি জাল করার মাধ্যমে ঋণ অনুমোদন নিয়েছেন। সিআইডির ফরেনসিক রিপোর্টেও জালিয়াতির বিষয়টি উঠে এসেছে। এ ছাড়া ব্যাংক, ঋণগ্রহীতা ও ডেভেলপারের মধ্যে চুক্তিতে থাকা ফ্ল্যাট মর্টগেজ আকারে জমা থাকার কথা থাকলেও তা রাখা হয়নি। উল্টো ফ্ল্যাটটি নাজমুল হাসান ডেভেলপার কোম্পানির পক্ষ হয়ে মোস্তাক আহমেদ নামক এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফেরদৌসী বেগম বলেন, ‘নাজমুল হাসান স্কুলের চেয়ারম্যান থাকার সুযোগে আমার কাগজপত্র নিয়ে নেন। এরপর আমার ভিজিটিং কার্ড ও স্বাক্ষর জাল করে ব্যাংক থেকে আমার নামে ঋণ নিয়েছেন। অথচ এ বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। ব্যাংকের ঋণ আবেদনপত্রে আমার ও আমার পরিবারের মোবাইল নম্বরের স্থানে নাজমুল হাসান তার কর্মচারীদের নম্বর ব্যবহার করেছেন। এ ছাড়া আমার ছেলে বিদেশে অবস্থান করায় ছেলের আইডি কার্ড ও ছবির জায়গায় তার কর্মচারীর ছবিও ব্যবহার করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নাজমুল হাসানের করা ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো আমার নামে মামলা করেছে। এ মামলায় বারবার হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। পাশাপাশি নাজমুল হাসানের বিরুদ্ধে করা মামলাও তাকে পরিচালনা করতে হচ্ছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সেলিম আর এফ হোসেন ব্যাংকের রিটেইল ব্যাংকিং বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

ব্র্যাক ব্যাংকের রিটেইল ব্যাংকিংয়ের প্রধান মাহিউল ইসলাম বলেন, ‘এই ঋণ ২০১৬ সালের মার্চ মাসে নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী তিন বছর এ ঋণের কিস্তিও পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ হয়ে গেলে আমরা যোগাযোগ করি। ওই সময় ফেরদৌসী বেগম অভিযোগ করেন, তিনি এ ঋণের বিষয়ে কিছুই জানেন না। পরে আমরা তদন্ত করে এ বিষয়ে সত্যতা পাইনি। এমনকি তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগও করেছেন। বিষয়টি জানতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমাদের ডাকা হলে আমরা এ বিষয়ে প্রমাণপত্র উপস্থাপন করেছি। ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় আমরা মামলা করেছি, যা বর্তমানে বিচারাধীন।’

নাজমুল হাসান মধুমতি ব্যাংকের অন্য এক প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

Share This Article