দ্য ইকনোমিস্টের প্রতিবেদন : ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়ে ইউরোপে বেশি মানুষ মরবে জ্বালানির দামবৃদ্ধিতে

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সন্ধ্যা ০৬:৫১, শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২২, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪২৯

রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো, নর্ডস্ট্রিম পাইপলাইন। আগস্ট মাস থেকে নানান অজুহাতে এ পাইপলাইন বন্ধ রেখেছে মস্কো। আর তাতেই বিপাকে পড়েছে গোটা ইউরোপ।

প্রথম পর্ব

যুদ্ধে জিততে হলে পুতিনকে এমন কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে, যাতে পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করে। আর এই শীতেই হয়তো সুযোগের চরম সদ্ব্যবহার করতে যাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আসন্ন শীতে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ রাখাটাই হতে পারে রুশ প্রেসিডেন্টের জন্য তুরুপের তাস।

জানা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ইউরোপকে মোট চাহিদার ৪০-৫০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়েছিলেন পুতিন। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর চলতি বছরের আগস্ট থেকে পুরো ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে পুতিন সরকার।

রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো, নর্ডস্ট্রিম পাইপলাইন। আগস্ট মাস থেকে নানান অজুহাতে এ পাইপলাইন বন্ধ রেখেছে মস্কো। আর তাতেই বিপাকে পড়েছে গোটা ইউরোপ।

jagonews24

পুতিনের এক চালেই ইউরোপজুড়ে হুড়হুড় করে বাড়তে শুরু করেছে জ্বালানির দাম, যা আসন্ন শীতে অনেক বেশি কঠিন করে তুলবে লাখ লাখ ইউরোপীয় নাগরিকদের জীবন।

দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, এখন পর্যন্ত ইউরোপ এ ধাক্কা ভালোভাবে মোকাবিলা করে যাচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলোর দাবি, তারা পর্যাপ্ত গ্যাস মজুত করে রেখেছে। কিন্তু পাইকারি বাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উদি্‌বগ্নতা দেখা দিয়েছে গোটা ইউরোপেই।

অনেকে আবার বলছেন, পাইকারি বাজারে দাম বাড়লেও, ইউরোপের খুচরা বাজারে জ্বালানির দাম কিছুটা কমেছে। তবে গড় আবাসিক গ্যাস ও বিদ্যুতের খরচ ২০০০-২০১৯ সালের তুলনায় যথাক্রমে ১৪৪ শতাংশ ও ৭৮ শতাংশ বেড়েছে।

ইউরোপের এমন পরিস্থিতি দেখে বোঝা যায়, ইউক্রেনীয়রা কী পরিমাণ ভয়াবহতা সহ্য করছেন। ভলোদিমির জেলেনস্কির দেশের নাগরিকদের অবর্ণনীয় ভোগান্তির কাছে ইউরোপের ভোগান্তি বলতে গেলে কিছুই না।

jagonews24

এরপরও যতটুকু ভোগান্তিতে ইউরোপিয়ানরা পড়েছেন, সেটুকুই তাদের কাছে পাহাড়সম মনে হচ্ছে। কারণ শীতে যখন গ্যাসের সর্বশেষ মজুতটুকুও ফুরিয়ে যাবে, তখন খাবারের অভাবে নয়, ঠাণ্ডার প্রকোপে মরতে হবে তাদের।

অনেকের মতে, আবহাওয়া, জ্বালানি ও মৃত্যুহারের মধ্যে যদি সুষম সম্পর্ক বজায় না থাকে তাহলে পুতিনের ‘জ্বালানি অস্ত্র’ বা ‘জেনারেল উইন্টার’ এর কারণে যুদ্ধে যে পরিমাণ ইউক্রেনীয় মারা গেছেন, তার থেকে বেশি ইউরোপিয়ান মারা যাবেন।

ইউরোপের মানুষদের জন্য সাধারণত উচ্চ তাপমাত্রাকে প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। কারণ, এ অঞ্চলের মানুষ গরম খুব একটা সহ্য করতে পারেন না। তবে নিম্ন বা অতি ঠান্ডা তাপমাত্রাও ইউরোপের জন্য কম ভয়ংকর নয়। এখানে জুন-আগস্টের তুলনায় ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারির প্রতি সপ্তাহে ২১ শতাংশ বেশি মানুষ মারা যান।

এদিকে, অতীতে জ্বালানির দামবৃদ্ধির সঙ্গে প্রাণহানির সম্পর্ক সামান্য থাকলেও, এ বছরের দামবৃদ্ধির হার গতি অনেক বেশি। নিচের পরিসংখ্যানটি দেখলে বুঝতে সুবিধা হবে।

বলা হচ্ছে, এ বছর ইউরোপে জ্বালানির দাম ও শীতকালীন মৃত্যুর মধ্যকার সম্পর্ক পরিবর্তন হতে পারে। এমনকি, এ সম্পর্ক যদি আগের মতো থাকে ও বিদ্যুতের দাম যদি এখন যা আছে তাই থাকে, তাহলেও শীতকালীন মৃত্যুর সংখ্যা ইউরোপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ হতে পারে। এমনকি ভারি শীত নয়, মাঝামাঝি শীতেই এমনটি ঘটতে পারে।

jagonews24

শীতকালীন মৃত্যুর মোট সংখ্যা অবশ্য অন্যান্য কারণের ওপরেও নির্ভর করে, বিশেষ করে তাপমাত্রার ওপর। দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, মৃদু শীতে ইউরোপে মৃত্যুর সংখ্যা ৩২ হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। তবে পুরোপুরি শীতে তিন লাখ ৩৫ হাজার মানুষ নিজেদের গরম রাখতে না পেরে মারা যেতে পারেন।

শীতে ইউরোপের (ইউক্রেনের বাইরে) কতজন লোক মারা যাবেন তা মূলত নির্ভর করছে কয়েকটি বিষয়ের ওপরে। দুটি সবচেয়ে সহজবোধ্য বিষয় হলো, শীতকালীন ফ্লু ছড়িয়ে পড়া ও তাপমাত্রা একেবারে কমে যাওয়া। শীত বা ঠান্ডা যেকোনো ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে ও মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

তাছাড়া, অতিরিক্ত ঠান্ডায় শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্ত জমাট বেধে যায় ও রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, যা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। অধিক ঠান্ডায় মানুষের শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।

যুক্তরাজ্যে কার্ডিওভাসকুলার রোগে সাপ্তাহিক মৃত্যুর হার গ্রীষ্মের তুলনায় শীতকালে ২৬ শতাংশ বেশি। তাছাড়া শীতে দেশটিতে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা ৭৬ শতাংশ বেড়ে যায়। বিশেষ করে বয়স্কদের মধ্যে এ মৃত্যুহার বেশি।

ইউরোপজুড়ে কমপক্ষে ২৮ শতাংশ ৮০ বছর বয়সী মানুষ শ্বাসকষ্টজনিত রোগে মোট মৃত্যুর ৪৯ শতাংশের জন্য দায়ী। আর এসব মৃত্যু গ্রীষ্মকালের থেকে শীতকালে অনেক বেশি হয়ে থাকে।

তবে আশ্চর্যজনকভাবে, শীতল দেশগুলোর তুলনায় উষ্ণ দেশগুলিতে মৌসুমী মৃত্যুর হার অনেক বেশি। পর্তুগালে গ্রীষ্মকালের তুলনায় শীতকালে প্রতি সপ্তাহে ৩৬ শতাংশ বেশি মানুষ মারা যান। অথচ ফিনল্যান্ডে গ্রীষ্মের তুলনায় পুরোপুরি শীত চলাকালীন মাত্র ১৩ শতাংশ বেশি মানুষ মারা যান।

jagonews24

শীতল দেশগুলোর কার্যকরী ও অত্যাধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়া, অধিকাংশ শীতপ্রধান দেশের জনগণ তুলনামূলক সম্পদশালী ও তাদের তরুণ জনসংখ্যা অনেক বেশি।

এরপরও পরিসংখ্যান বলে, ঠান্ডায় ওইসব ধনী দেশের মানুষ মারা যান। এমনকি শীতকালে, একটি নির্দিষ্ট শীতপ্রধান দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস কমলে ১ দশমিক ২ শতাংশ বেশি মানুষ মারা যান।

ধারণা করা হচ্ছে ২০২২-২৩ সালে ইউরোপে শীতকালের তাপমাত্রা সাম্প্রতিক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিংবা সবচেয়ে কম হতে পারে। এখন যেহেতু করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বিধি নিষেধ শিথিল করা হয়েছে, তাই শীতকালে ইউরোপের দেশগুলোতে ফ্লু বা বায়ুবাহিত ভাইরাসের কারণে মৃত্যুর হার ২০০০-২০১৯ সালের মতোই হতে পারে।

চলবে..

Share This Article