'শেখ হাসিনা সরকার' উৎখাতে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি: ইন্ডিয়া টুডে

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ বিকাল ০৪:৩৬, বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২২, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪২৯
  • নিউ ইয়র্ক টাইমসে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে নিবন্ধ
  • গণতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রথম ও প্রধানতম বাধা তিনি
  • বিশ্বের খ্যাতনামা রাজনৈতিক বিশ্লেষক বার্টিল লিন্টনার

 

বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের  এক বছর বাকি থাকতেই অস্থির হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দৃশ্যপট। মাঠের বিরোধী দল বিএনপির শীর্ষ নেতারা বারবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে "উৎখাত" করার হুমকি দিয়ে আসছেন।

বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী ১০ ডিসেম্বর ঘোষণা দেওয়া হবে সরকার পতনের আগ পর্যন্ত দেশজুড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচির। সাম্প্রতিক জনসভায় বিএনপির শীর্ষ নেতা আমানউল্লাহ আমান বজ্রকণ্ঠে বলেন, ১০ ডিসেম্বর থেকে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার নির্দেশে দেশ পরিচালিত হবে।

এতে স্পষ্টভাবেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ইসলামী গোষ্ঠীটি যে বিরোধী জোট গঠন করেছে তারা সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে রাজপথে সহিংস আন্দোলন করতে পারে বলে আভাস ফুটে উঠেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশে চলমান সংকটকে রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীলতার জন্য ব্যবহারের উদ্দেশ্য প্রকাশ পেয়েছে। যদিও এসব আন্দোলনের কারণে উৎপাদন ও বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হওয়ায় অর্থনীতি ব্যাহত হলে সেটি বরং বিএনপির জন্যই নেতিবাচক হতে পারে বলে মত অনেকের। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য বিএনপির 'সরকার উৎখাতের প্রচেষ্টা' বাংলাদেশের জন্য কাটা ঘায়ে লবণের ছিটার মতো।

বিএনপি হয়তো মনে করছে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের কারণে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা জোরদার হওয়াকে আসন্ন মন্দা হিসেবে তুলে ধরে সরকারের পতন ঘটাতে পারবে।তবে আন্দোলন যেহেতু উৎপাদন ও বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করে অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সেহেতু সরকারকে রাজপথ থেকে নামানোর জন্য বিএনপির পরিকল্পনা বিফল হতে পারে কারণ, এখন পর্যন্ত এই দাবির পক্ষে যথেষ্ট জনমতের ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বিএনপি তার প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সাথে নির্বাচন বর্জন করাসহ রাজপথে সহিংসতার আশ্রয় নেয়। কিন্তু ব্যারাকে জন্ম নেওয়া এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে অনভিজ্ঞ বিএনপি সেই উদ্দেশ্য অর্জনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।  

নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত, তারপরে রাজপথে অগ্নি সন্ত্রাস, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর টার্গেট করে হামলা ও সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা চালানো বিএনপি-জামায়াত জোটের পক্ষ থেকে "সবচেয়ে বড় ভুল" হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। বিএনপি-জামাতের সহিংতায় শত শত নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়।

বিএনপির গত কয়েকটি সমাবেশে নেতাদের শক্তি প্রদর্শন করে 'ক্ষমতা দখলের' দাবির বিপরীতে রাজধানীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুব সংগঠন যুবলীগ আয়োজিত জনসভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ড্রোন ফুটেজে যুবলীগের সমাবেশে বিএনপির সমাবেশেরও কয়েকগুণ জনসমাগম হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্ব:

একজন পলাতক ও সাজাপ্রাপ্ত আসামি, সহিংস রাজনীতির প্রতীক হিসেবে দীর্ঘ রেকর্ড থাকা তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপি যেকোনও নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রথম ও প্রধানতম বাধা হয়ে আবির্ভূত হয়েছে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পতনের ঠিক পরে উইকিলিকসের ইউএস ক্যাবলস ধারাবাহিকের তথ্য অনুসারে, “বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান যে ঘুষ, আত্মসাৎ ও  দুর্নীতির সংস্কৃতির প্রচলন করেছিলেন যেটা সরাসরি ও সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশে মার্কিন ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের অনেক সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে গেছে।"

উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া তথ্যে আরো বলা হয়, তারেক রহমানের জনগণের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার চুরি মধ্যপন্থী ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষুণ্ন করেছে। এছাড়া কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার গড়ে তোলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টাকে বিপর্যস্ত করেছে।

তারেককে বাংলাদেশের "ছায়া সরকার ও সহিংস রাজনীতির" প্রতীক হিসাবে আখ্যা দিয়ে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর ওয়াশিংটনে একটি গোপন প্রতিবেদন  পাঠান। সেখানে বলা হয়, তারেকের সুস্পষ্ট দুর্নীতি মার্কিন মিশনের লক্ষ্যকেও মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের স্থান না দেওয়ার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রধান অগ্রাধিকার ও কূটনীতি হিসেবে গণ্য। তবে তারেকের ‘‘দুঃসাহসী দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকাণ্ড" এসব নীতিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

মরিয়ার্টি তার প্রতিবেদনে বলেন, “তারেকের অর্থ আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ বাংলাদেশে আইনের শাসনকে ক্ষুণ্ন করে। স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনিমার্ণে মার্কিন লক্ষ্যকে ক্ষুন্ন করে। তারেক রহমানের কলুষিত ব্যবসায়িক চর্চা ও ঘুষের রীতি চালু বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিদেশী বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করেছিল এবং মার্কিন কোম্পানিগুলোর আন্তর্জাতিক কার্যক্রমকে জটিল করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মার্কিন প্রচেষ্টাকে লাইনচ্যুত করেছে।  

মার্কিন ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) দ্বারা পরিচালিত একটি তদন্তে পাওয়া গেছে যে, সিলেটের গ্যাস ক্ষেত্র লিজ দিতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কানাডার কোম্পানী নাইকোকে অনৈতিকভাবে সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখানো হয়। এতে রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল। এর সাথে সরাসির যুক্ত ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তার ছেলে তারেক রহমান।

গুরুত্বপূর্ণ হলো, ক্ষমতার পরিবর্তন দিল্লিকে ঢাকার প্রতি আস্থাহীন করে তুলতে পারে। কারণ বিএনপি-জামায়াত জোট দীর্ঘদিন ধরে ভারতবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী ও পাকিস্তান সমর্থিত ইসলামি জঙ্গিদের সমর্থক হিসেবে পরিচিত। ক্ষমতার পরিবর্তন হলে আবার অস্তির হয়ে উঠকে পারে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কর্মকাণ্ড।

সন্ত্রাসী পাচারকারী:
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ইন্ডিয়া টুডে-এর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন যে "আগের সরকারের আমলে সন্ত্রাসীদের পাচার করা হতো"। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে (২০০১-২০০৬) বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রশ্নের জবাবে এমন মন্তব্য করেন তিনি।

আসামে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসা প্রসঙ্গে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, "শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থান আসামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনেক সাহায্য করেছে। আমরা কৃতজ্ঞতার সাথে তা স্বীকার করি।

উত্তর-পূর্ব ভারতের লেখক সুবীর ভৌমিক এর মতে, "উত্তর-পূর্ব ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গ্রেফতার অভিযান দিল্লিকে স্বত্বি দেয় কারণ সেই অভিযানের ফলে ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্রোহের তীব্রতা কমাতে ব্যাপক অবদান রাখে। এটি ভারতকে চীনের সাথে তার উত্তেজনাপূর্ণ বিতর্কিত হিমালয় সীমান্তে সেনা মোতায়েন করতে সহায়তা করেছে।  ঢাকার সরকার পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ভারতের জোরালো সমর্থনের কারণ শেখ হাসিনা ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে ট্রানজিট সুবিধা এবং বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর “দেশে কোনো জঙ্গি নেই এবং সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানকে রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট নাটক ‘’ বলে মন্তব্য করেন। জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা ঘাঁটি হিসেবে আগে পরিচিত পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কর্তৃক কয়েকজন জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর মির্জা ফখরুল এই মন্তব্য করেন। তার এই মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে অনেক নেটিজেন তাকে ‘পলাতক তারেক রহমান কর্তৃক উৎসাহিত জঙ্গিদের সমর্থক’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন।

বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে বৃহত্তম অস্ত্র আটকের ঘটনা ঘটে। এসব অস্ত্র আসামের উলফার মতো ভয়ঙ্কর গোষ্ঠীর কাছে পাঠানো হচ্ছিল। ১০ ট্রাক ভর্তি অস্ত্র আটক করা হয়। আদালতে এই মামলার বিচারে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফর রহমান বাবরের সম্পৃক্তা পাওয়া যায়।

বিশ্বের খ্যাতনামা রাজনৈতিক বিশ্লেষক বার্টিল লিন্টনারের ২০০২ সালের ৪ এপ্রিল ওয়াশিংটন পোস্টে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বাংলাদেশকে "সন্ত্রাসের আতুড় ঘর" হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। বার্টিল লিন্টনার সুইডিশ লেখক ও সাংবাদিক।  

এর পরের বছর ২০০৫ সালের ২৩ জানুয়ারি নিউ ইয়র্ক টাইমসে মার্কিন নিরাপত্তা বিশ্লেষক এলিসা গ্রিসওল্ডের একটি নিবন্ধন প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি বাংলাদেশে আফগান স্টাইলের ইসলামি বিপ্লবের ভবিষ্যদ্বাণী করেন। আরও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনামেও বিএনপি-জামায়াত সরকারের শাসনামলের জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতার কথা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘শেখ হাসিনাকে স্পষ্টতই জঙ্গি বিরোধী কার্যক্রমে তার দৃঢ় সংকল্পের জন্য যথাযথ কৃতিত্ব দেওয়া উচিত। একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশের জন্য তার কারণেই জঙ্গি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে।’ বাংলাদেশের এই বিষয়টিকেই অনেকে 'মানব উন্নয়নের মডেল' হিসেবে বর্ণনা করেন। 

তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়া টুডে, 
লেখক: শহীদু হাসান খোকন 
প্রকাশ: ২০ নভেম্বর-২০২২ 

Share This Article