বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে যেভাবে কাতারকে ভুলভাবে উপস্থাপন করছে পশ্চিমারা

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ রাত ০৮:০৬, রবিবার, ২০ নভেম্বর, ২০২২, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৯

এ কথা সত্য যে কাতারে মাঝেমধ্যে অভিবাসী শ্রমিকরা বিরূপ আচরণের শিকার হন, কিন্তু তারা এখানে যে পরিমাণ অর্থ আয় করেন সেটা তাদের জীবনকেই বদলে দেয়। এ কারণেই এত বেশি শ্রমিক কাতারে কাজ করতে যান। চীন দুইবার অলিম্পিকের আয়োজন করল, কিন্তু তা-তে তো দেশটির গণতন্ত্রে কোনো উন্নতি হয়নি। অন্যদিকে বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগে কাতারের শ্রম আইনে উন্নয়ন ঘটেছে।

 

২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পেয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশ কাতার। তবে কাতারের অনেক বিষয় নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো এর সমালোচনা করছে। ২০১০ সালে কাতার যখন বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায়, তখন ফিফা'র প্রেসিডেন্ট ছিলেন সেপ ব্লাটার। সেই ব্লাটারই কয়দিন আগে বলেছেন, কাতারকে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে দেওয়া ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।

শনিবার (১৯ নভেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে কাতারের এ সবিশেষ পশ্চিমা সমালোচনার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ফিফা'র বর্তমান সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো। তিনি মনে করেন, কাতারের মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে পশ্চিমাদের সমালোচনা একধরনের 'ভণ্ডামি'। গত ৩,০০০ বছরে ইউরোপ এ বিশ্বে যা যা করেছে, তার জন্য আগামী ৩,০০০ বছর ইউরোপীয়দের ক্ষমা চাওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন ইনফান্তিনো।

তবে কিছু কিছু পশ্চিমা গণমাধ্যমে কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজনের পক্ষেও মত দেখা গিয়েছে। সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্ট-এর এক লেখায় কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজনের সমর্থনে কিছু যুক্তি তুলে ধরা হয়। এছাড়া স্কটিশ সংবাদপত্র দ্য হেরাল্ড-এও পশ্চিমা দেশগুলো কাতারের সমালোচনা আদৌ করতে পারে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।


কাতারে গণতন্ত্র নেই। দেশটিতে করুণ ভাগ্যই বরণ করতে হয় অভিবাসী শ্রমিকদের। যৌন-স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও পশ্চিমা দেশকে 'মানদণ্ড' হিসেবে ধরলে তার তুলনায় পিছিয়ে কাতার। কিন্তু এ কথাগুলো গতবছর বিশ্বকাপ আয়োজন করা রাশিয়ার জন্যও প্রযোজ্য। সম্প্রতি অলিম্পিক আয়োজনকারী দেশ চীনও এ বিবৃতিগুলোর সত্যতা থেকে নিজেকে আড়াল করতে পারবে না।

কাতারের বিরুদ্ধে এসব সমালোচনার অনেক খুঁত রয়েছে। এসব সমালোচনায় পশ্চিমারা কাতারকে একটি পুরোদস্তুর স্বৈরাচারী রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলছে। এগুলোর অনেকটাই আবার মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি সম্পর্কে স্রেফ অন্ধ কুসংস্কার বা ভুল ধারণা। অনেকের সমালোচনা শুনে তো মনে হচ্ছে তারা মোটাদাগে মুসলিম বা ধনীদের পছন্দ করেন না।

কাতার হয়তো গণতান্ত্রিক দেশ নয়। তবে পশ্চিমা সংবাদপত্রের এডিটোরিয়াল কার্টুনে দেখানো স্বৈরাচারী দেশও নয় এটি। দেশটির আগের আমির কোনো প্রকার চাপে না থেকেও কাতারে একপ্রকার নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি আল জাজিরার মতো সংবাদমাধ্যমও প্রতিষ্ঠা করেছেন। এসবের তুলনায় ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়ায় বর্তমানে যা চলছে তা আরও নিন্দনীয়। আর চীনে তো কোনো রাজনৈতিক ভিন্নমতের স্থানই নেই।

বিশ্ব কাতারের অভিবাসী শ্রমিকদেরও ভাঙা চশমা দিয়ে তাকায়৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের কোনো দেশের তুলনায় কাতারে বিদেশি শ্রমিকদের কাজের সুযোগ অনেক বেশি। দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশ কাতারি, বাকিরা বাইরের থেকে আসা মানুষ, যাদের বেশিরভাগ কাজের খোঁজে দেশটিতে গিয়েছেন।

এ কথা সত্য যে কাতারে মাঝেমধ্যে অভিবাসী শ্রমিকরা বিরূপ আচরণের শিকার হন, কিন্তু তারা এখানে যে পরিমাণ অর্থ আয় করেন সেটা তাদের জীবনকেই বদলে দেয়। এ কারণেই এত বেশি শ্রমিক কাতারে কাজ করতে যান। চীন দুইবার অলিম্পিকের আয়োজন করল, কিন্তু তা-তে তো দেশটির গণতন্ত্রে কোনো উন্নতি হয়নি। অন্যদিকে বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগে কাতারের শ্রম আইনে উন্নয়ন ঘটেছে।

কাতার 'হোমোফবিক'; এ দাবিতেও গণ্ডগোল আছে। দেশটি সমকামী সম্পর্ক অবৈধ, এটা সত্য। কিন্তু একইভাবে বিয়ের বাইরে অন্য যেকোনো সম্পর্কই এখানে অবৈধ। তবে এসব আইন ভঙ্গের কারণে কাতারে বিচারের পরিমাণও বেশ কম। বিশ্বের উন্নয়নশীল অনেক দেশেই এবং প্রায় সব মুসলিম দেশেই এ ধরনের আইন রয়েছে। কাতারের আইনটি যে বিশেষ বা স্বতন্ত্র, তাও নয়।

স্কটিশ সংবাদপত্র দ্য হেরাল্ড-এর সাবেক উপসম্পাদক কেভিন ম্যাককেনা লিখেছেন, সৌদি আরবেও নারী ও সংখ্যালঘুরা নিপীড়নের শিকার হন৷ অথচ দেশটি যুক্তরাজ্যের অন্যতম একটি মিত্রদেশ। তিনি বলেন, যৌনতা, সমকামিতা ইত্যাদি নিয়ে সৌদি আইন; মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে জামাল খাশোগির হত্যায় জড়িত থাকার পশ্চিমা গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর অভিযোগ ইত্যাদি প্রসঙ্গে কখনোই বিশেষ উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় না যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য 'প্রগতিশীল' পশ্চিমা দেশগুলোকে।

কাতারের আরেকটি সমালোচনা হচ্ছে, তারা বিশ্বকাপের আসর অর্থের জোরে কিনে নিয়েছে। এ দাবিও হয়তো সত্য, যদিও এ বিষয়ে জনসমক্ষে কোনো পরিষ্কার প্রমাণ দেখানো হয়নি। আর যদি এটি সত্য হয়, তাহলে তা কাতারের চেয়ে ফিফা'র দুর্নীতির দিকটাই বেশি ইঙ্গিত করে।

কাতারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সমালোচনার আরেকটি হলো পরিবেশগত বিষয়। দেশটির তীব্র গরমে বিশ্বকাপ আয়োজনের সমালোচনা করা হয়। গরম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিছু স্টেডিয়ামে শীতলীকরণ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর ফলে প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হবে বলে বিতর্ক তৈরি হলেও ফিফার দাবি এ বিশ্বকাপে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে, তা এ বছরের মোট বৈশ্বিক নিঃসরণের কেবল ০.০১ শতাংশ।

ফিফা যদি ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন ইত্যাদিতে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে না চায়, তাহলে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এ ক্রীড়া আসরটি আয়োজন করার জন্য সংস্থাটির কাছে কোনো অবিসংবাদিত জায়গা নেই। তাই বিশ্বকাপকে কেবল বিশ্বের সামনেই উপস্থাপন করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে ফুটবলের ভক্তের অভাব নেই, কিন্তু এটি এর আগে কখনো ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করেনি। কোনো মুসলিম দেশেরও এ সুযোগ হয়নি। আর এমন কোনো স্থানে যদি বিশ্বকাপ আয়োজন করতে হয়, তাহলে কাতারই সবচেয়ে উপযুক্ত দেশ।

রবিবার (২০ নভেম্বর) রাতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বকাপ আয়োজন শুরু করতে যাচ্ছে কাতার। প্রথম ম্যাচে ইকুয়েডরের বিরুদ্ধে লড়বে স্বাগতিক এ দেশটি।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বিশ্বের অনেক শীর্ষ নেতাই। দেখা যাবে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্সকেও। তবে কয়জন পশ্চিমা নেতা অনুষ্ঠানে থাকবেন, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

বিষয়ঃ ফিফা

Share This Article