মাঠ প্রশাসনে নিয়োজিতদের যে নির্দেশনা দিবেন ইসি

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:১০, সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০২২, ১৮ আশ্বিন ১৪২৯

জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ফেরাতে বড় উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরই অংশ হিসেবে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সব ধরনের রাজনৈতিক হয়রানি বন্ধের নির্দেশনা আসছে।

এ লক্ষ্যে মাঠ প্রশাসনকে নিয়ে ঢাকায় বৈঠকে বসতে যাচ্ছে রাজনৈতিক বিতর্কে থাকা সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠান।

সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, জাতীয় সংসদের ভোট সামনে রেখে আগাম বার্তা দিতেই আগামী শনিবার ঢাকার নির্বাচন ভবনে ৬৪ জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারকে (এসপি) নিয়ে একটি সভা ডাকা হয়েছে। ওই সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও মহাপুলিশ পরিদর্শকেরও (আইজিপি) উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।

দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দল এরই মধ্যে সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ দেশের নিবন্ধিত অনেক রাজনৈতিক দল কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন ইসির ওপর অনাস্থা জানিয়ে আসছে।

ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংসদ নির্বাচনের এক বছরেরও বেশি সময় বাকি। তবু শনিবারের বৈঠকে মাঠ প্রশাসনকে কড়া সতর্কতা জানাতে চাচ্ছে ইসি। দলগুলোর প্রতি নিরপেক্ষ আচরণের মাধ্যমে এখন থেকেই সব দলের জন্য সমান আচরণ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) সৃষ্টির কাজ শুরুর নির্দেশনা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ওই বৈঠকে। এ জন্য একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরিতে কাজ শুরু করেছেন কমিশনের সদস্যরা। এই গাইডলাইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের চেষ্টা থাকবে ইসি কর্তাদের।

ইসি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী ১৭ অক্টোবর ৬১ জেলা পরিষদের ভোট। পাশাপাশি ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা ও ৫ নভেম্বর ফরিদপুরের একটি আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সাধারণত নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংশ্নিষ্ট নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত মাঠ প্রশাসনকে ডাকা হয়। তবে এবার সারাদেশের মাঠ প্রশাসনকে একই সঙ্গে ডাকায় বৈঠক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে।

গতকাল রোববার ইসি কার্যালয়ের নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপসচিব আতিয়ার রহমানের সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, 'নির্বাচন-সংশ্নিষ্ট বিষয়ে সব জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ৮ অক্টোবর শনিবার সকাল ১০টায় ঢাকায় নির্বাচন ভবনে একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সভাপতিত্বে এই সভায় নির্বাচন কমিশনার, ইসি কার্যালয়ের সচিব ও সংশ্নিষ্ট অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।'

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, ইসির সামনে এ মুহূর্তে জেলা পরিষদসহ দুটি উপনির্বাচন রয়েছে। এর পরপরই রংপুরসহ অনেক সিটি করপোরেশন, সংসদ নির্বাচনসহ সব বিষয়ে এ বৈঠকে আলোচনার পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনী লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টিসহ সার্বিক বিষয়ে মাঠ প্রশাসন থেকে পরামর্শ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে তাদের দেওয়া হবে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। ইসি মনে করছে, সব ভোট নিয়ে মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে এখনই বৈঠকের প্রয়োজন। তাই এ বৈঠক শুধু জেলা পরিষদ ভোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না; সব বিষয়েই এখানে আলোচনা হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, আজকালের মধ্যে কমিশনের সদস্যরা নিজেরা বসে আলোচনার বিষয়গুলো চূড়ান্ত করবেন। ইসি মনে করছে, জাতীয় নির্বাচনের আগেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রস্তুত করা, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সমান দৃষ্টি দেওয়ার নির্দেশনা এখনই মাঠ পর্যায়ে দেওয়া প্রয়োজন। ইসি ঘোষিত রোডম্যাপ বাস্তবায়নে মাঠ প্রশাসনের করণীয় নিয়েও বৈঠকে আলোচনার কথা জানান নির্বাচন কমিশনের এই সদস্য।

ইসি ঘোষিত রোডম্যাপে বলা হয়েছে, চলতি একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। ফলে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন শেষ করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশভাবে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। তবে ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। কারণ, ওই নির্বাচনের ফল ছিল সম্পূর্ণ একপক্ষীয়। তখন বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো ফল প্রত্যাখ্যান করে পুনর্নির্বাচনের দাবি তুলেছিল। বিএনপির ঘোষণা অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে তারা আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে না। অন্যদিকে, বর্তমান সংসদের প্রধান বিরোধী দল এবং গত তিন নির্বাচনে (নবম, দশম ও একাদশ সংসদ) আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ জোট শরিক জাতীয় পার্টিও বলছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার বিষয়ে তারা সন্দিহান। তবে তারা বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার বিরোধী। জাতীয় পার্টি মনে করছে, ইসিকে আরও শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন সম্ভব।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, আগামী বছরের শেষ দিকে জাতীয় নির্বাচনের আগেই আগামী ডিসেম্বরে রংপুর সিটির ভোট হবে। আগামী জুনের মধ্যেই হবে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল সিটির ভোট। এর পরপরই ঢাকার উপকণ্ঠে গুরুত্বপূর্ণ শহর গাজীপুর সিটির ভোট রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব ভোটের মাধ্যমেই মাঠ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা সবার সামনে ফুটিয়ে তোলা হবে; যাতে জাতীয় নির্বাচনের আগে সব দলের আস্থা অর্জন সম্ভব হয়।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর রোডম্যাপ ঘোষণাকালে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর জানান, ২০২৩ সালের নভেম্বরে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হতে পারে। ওই বছরের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। সে হিসেবে ইসির হাতে সময় রয়েছে আরও ১৩ মাস।

ইসি-সংশ্নিষ্টরা জানান, ঘোষিত রোডম্যাপে ১৪ দফা চ্যালেঞ্জ ও ১৯ দফা উত্তরণের উপায় চিহ্নিত করা হয়েছিল। ওই রোডম্যাপ বাস্তবায়নের নির্দেশনাও দেওয়া হবে এ বৈঠকে। ইসির রোডম্যাপে দুই নম্বর চ্যালেঞ্জ ছিল 'নির্বাচনের দায়িত্বে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা, বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন'; সাত নম্বর চ্যালেঞ্জ ছিল 'নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে বিপক্ষ-প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী-সমর্থক-পুলিশ-প্রশাসন কর্তৃক কোনো রকম বাধার সম্মুখীন না হওয়া'।

শনিবারের বৈঠকে ডিসি-এসপিদের এ দুটি বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে। সব দলের সঙ্গে নিরপেক্ষ আচরণ, সরকারের কোনো সংস্থা কর্তৃক হয়রানিমূলক মামলা না করা, কোনো প্রার্থীর বাড়িঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ না করা এবং আক্রান্ত হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। পাশাপাশি নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হবে বৈঠকে।

একই সঙ্গে নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনে অনীহা, পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ প্রমাণে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে 'নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন-১৯৯১' অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করা হবে মাঠ প্রশাসনকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবীব খান বলেন, সব ধরনের নির্বাচন পরিচালনায় জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সংশ্নিষ্টতা ও সম্পৃক্ততা রয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচন ছাড়াও সামনে জেলা পরিষদ এবং সিটি করপোরেশন নির্বাচন রয়েছে। তাই সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কমিশন মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে চায়; জেলা পর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারীদের চ্যালেঞ্জগুলো জানতে চায়। এ কারণে আগামী সব নির্বাচন সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতেই জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের সঙ্গে মতবিনিময়, সমন্বয় সাধন ও নির্বাচন-সংশ্নিষ্ট বিষয় নিয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়াই এই বৈঠকের উদ্দেশ্য।

তিনি বলেন, এ ছাড়া নির্বাচন পরিচালনায় চ্যালেঞ্জগুলো উত্তরণের পথ বের করতে মতবিনিময় করবে কমিশন। তাঁর মতে, শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করে অনেক সমস্যার সমাধান করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। কমিশন চায় নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ এবং আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে।

বিষয়ঃ ভোট

Share This Article