খাঁটি দুধের সন্ধানে রাজধানীতে খামারগুলোতে ছুটছে মানুষ

  নিজস্ব প্রতিবেদক
  প্রকাশিতঃ সন্ধ্যা ০৬:৪১, শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১৫ আশ্বিন ১৪২৯
ফাইল ফটো
ফাইল ফটো
  • প্রতিদিন নিবন্ধিত খামারে ২০ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে 
  • গাভিরও লজ্জা-শরম, ভয় আছে-তাই আড়ালে রাখা হয় 
  • সকাল-সন্ধ্যায় খামারগুলোতে ক্রেতাদের ভিড়

ব্যস্ত রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই দেখা গেল, সাধারণ মানুষের ভিড়। কারও হাতে প্লাস্টিক বোতল, কারোর হাতে স্টিলের জগ। দৃশ্যটি রাজধানীর সায়েদাবাদ ধলপুর বাঁশতলা এলাকা। এখানে গড়ে উঠেছে গাভির খামার পাঁচটি। তখনো ভোরের নরম আলো সে অর্থে পরিণত হয়নি। আলো-আঁধারের মাঝে কান পাতলে শোনায় যায় দুধ দোয়ানোর শব্দ।

বুধবার ভোরে ধলপুর কাঁচাবাজারের পাশের খামারে নামতেই দেখা গেল, সারিবদ্ধভাবে শ্রমিকরা দুধ দোয়াচ্ছেন। স্টিলের বালতিগুলো ভরে উঠছে দুধ আর ফেনায়। ৭টায় বিক্রি শুরু হয়। তখন গেট ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন ৭০-৮০ জন ক্রেতা। কেউ খুচরা, কেউ পাইকারি। ব্যক্তিপর্যায়ে দুই থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত দুধ নিচ্ছেন। পাইকারি ক্রেতারা ২০ লিটার থেকে দুই মণ পর্যন্ত দুধ কিনে ছুটছেন বাসা-বাড়ি, মহল্লায় বিক্রির উদ্দেশ্যে। মূলত এরাই খামার থেকে দুধ নিয়ে ঢাকা পাড়া মহল্লার বাসা-বাড়ি এবং ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিচ্ছেন। রোজ ভিত্তিতে দুধ দিয়ে দাম নিচ্ছেন মাস শেষে।

জানা গেছে, রাজধানীতে নিবন্ধিত খামার আছে তিন হাজার। প্রতিটিতে কমপক্ষে দশটি গাভি থাকলে সরকারের পক্ষ থেকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। এছাড়া নিবন্ধনের বাইরে আছে আরও প্রায় সাত হাজার খামার। যেগুলোতে গাভির সংখ্যা এক থেকে ৯টির মধ্যে। নিবন্ধিত তিন হাজার খামার থেকে দৈনিক প্রায় ২০ লাখ লিটার দুধ পাওয়া যায়। অনিবন্ধিত খামারগুলোতে গাভির সংখ্যা কম থাকায় দুধ পাওয়া যায় কম। প্রতিদিনই খামারে খুচরা-পাইকারি ক্রেতার ভিড় থাকলেও বেশির ভাগ দুধ নিয়ে যাচ্ছেন মিষ্টির দোকান মালিক, বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিরা। খুচরা ক্রেতারা খুব বেশি পাচ্ছেন না।

বাঁশতলার একটি খামারে গাভি রয়েছে ৩৩টি। খামারের কোথাও নাম লেখা নেই। শ্রমিক সুমনের ভাষ্য, নাম ছাড়াই চলে যাচ্ছে। ১০ জন শ্রমিক সকাল-সন্ধ্যা দুধ দোয়ায়। ৫-৬ মন দুধ মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়। সকাল-সন্ধ্যা ক্রেতার ঢল নামে। স্থানীয় খামার ব্যবসায়ী জিল্লুর হাজি বললেন, ‘সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ীসহ মানিকনগর এলাকায় প্রায় অর্ধশত খামার আছে। গাভিগুলোকে রাসায়নিক মুক্ত খাবার দেওয়া হয়। ফলে দুধের মান ভালো হয়। এখানে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু খুচরা ক্রেতাদের ৯০ শতাংশই প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার করছে। আমরা বারবারই বলি, প্লাস্টিক নয়-স্টিলের ক্যান ব্যবহার করুন।’

রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় প্রায় ৪০টি রেজিস্ট্রেশনকৃত গাভির খামার রয়েছে, এমন তথ্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরেও রয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, মোহাম্মদপুর খামারগুলোর চিত্র কিছুটা ভিন্ন। মিষ্টির দোকান মালিক, বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিরা বেশি দুধ কিনে নিচ্ছেন। মিরাজ দুগ্ধ খামারের ম্যানেজার বিল্লাল মিয়া ক্ষোভ উগরে বললেন, ‘পাইকারি নয়, খুচরো বিক্রি করতেই আমার ভালো লাগে। নারী-পুরুষ খামারে এসে সরাসরি দুধ নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু পাইকারদের জন্য খুচরো ক্রেতাদের ৮০ শতাংশই দুধ পাচ্ছেন না।’

রাজধানীর রামপুরা, মেরাদিয়া, দাসেরকান্দি, নাসিরাবাদ, গৌরনগর, ফকির আলী ওয়ার্ড ঘুরলে চোখে পড়ে গাভির প্রায় শতাধিক খামার। দুদিন ঘুরে খামার ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শহরে গাভি পালনের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বড় বড় খামার গড়ে উঠছে। এছাড়া ২টি, ৩টি কিংবা ৫টি গাভি পালন করছেন এমন ছোট খামারগুলো নজরে আসছে না। এসব খামারের দুধ পাশের বাড়ি কিংবা বহুতল ভবনের বাসিন্দারাই নিয়ে যাচ্ছেন। মেরাদিয়ায় খামার ব্যবসায়ী আলিম উদ্দিনের ভাষ্য, প্রবাসে ছিলেন-দেশে এসে ৩টি শঙ্কর জাতের গাভি কিনে শুরু করেন। এখন তিনি ৫৩টি গাভি এবং ১৩টি বাছুরের মালিক। সব খরচ শেষে মাসে আয় প্রায় চার লাখ টাকা।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (খামার) জিনাত সুলতানা বলেন, রাজধানীতে উন্নত জাতের গাভি পালন এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ১০ ফুট বাই ১৫ ফুটের একটি রুমেই ৪-৫টি গাভি পালন করছেন অনেকে। রাজধানীতে নিবন্ধনকৃত গাভি পালনের খামার রয়েছে তিন হাজারের বেশি। তিনি বলেন, এর প্রায় দ্বিগুণ রয়েছে ছোট ছোট খামার, যেখানে ২টি, ৩টি কিংবা ৫টি গাভি রয়েছে। যেগুলো নিবন্ধনে এখনো আসেনি। নিবন্ধিত খামারগুলোতে ৩০ থেকে ৩২টি গাভি রয়েছে। সে হিসাবে রাজধানীতে প্রায় লক্ষাধিক উন্নত জাতের গাভি পালন হচ্ছে। এ ধরনের গাভি থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০ লাখ লিটার দুধ পাওয়া যাচ্ছে।

মেরুল বাড্ডায় দুটি পাকা-অর্ধপাকা ঘরে ৫৪টি গাভি পালন করছেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘জীবনে সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে গাভি পালন। গাভি, বাছুরকে পরিবারের অংশ মনে হয়। এগুলো সুস্থ থাকলে আমরাও ভালো থাকি। প্রবাসী জীবনে কাতারে গাভি লালন-পালনে সম্পৃক্ত ছিলাম, এখন নিজেই এ ব্যবসা করছি। এক-একটি বাছুরই বিক্রি হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা!’।

কামরাঙ্গীরচর বেরিবাঁধ এলাকায় গাভির বেশ কয়েকটি বড় খামার রয়েছে। মিনুয়ারা মিনু নামের এক খামার ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। মোবাইল বাইরে রেখে খামারের নির্দিষ্ট একটি স্থানে নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে গাভিগুলো দেখতে দিলেন এ প্রতিবেদককে। এমনটা কেন করলেন? ব্যবসায়ী মিনুর উত্তর, ‘ গাভিরও লজ্জা, দুঃখ-কষ্ট আছে। গাভি বাচ্চা দেওয়ার সময় কাউকে ভিড় করতে দেইনি। বাচ্চা প্রসবের সময় গাভিরও লজ্জা হয়। লোকজনের ভিড় দেখলে কষ্ট পায়। খামার দেওয়ার শুরুতে গাভি দেখতে, বাচ্চা প্রসব হওয়া দেখতে সাধারণ মানুষ ভিড় জমাত, ছবি তুলত। তখন গাভিগুলো কম দুধ দিত। পশু চিকিৎসক দেখিয়েও তেমন লাভ হয়নি।

মিনুর কথায়, ‘মানুষের মতোই প্রজননের সময় কষ্ট এবং লজ্জা পায় গাভিও। বাচ্চা প্রসবের সময় নির্ধারিত লোক ছাড়া কারও সেখানে থাকা ঠিক নয়। লোকজন থাকলে গাভির মস্তিষ্কে আঘাত আসে। এতে গাভির আচার-ব্যবহার এবং শারীরিক প্রক্রিয়ায় অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। এ জন্যই আমরা গোপন করে গাভি পালন করি। খামারে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। ফ্রিজিয়ান জাতের গাভি কোলাহল একেবারেই সহ্য করতে পারে না। রাজধানীতে ঘনবসতি, তাছাড়া বিভিন্ন সড়ক যানের হর্ন তো আছেই। গাভিগুলোকে নিরিবিলি পরিবেশে রাখলে দুধও বেশি দেয়। তাই অধিকাংশ খামারিই গাভিকে আড়ালে রাখেন।

বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান হোসেন বলেন, খামারের সরাসরি দুধ পেতে খুচরো-পাইকারি ক্রেতারাই ব্যাকুল হয়ে থাকে। রাজধানীতে গাভি পালনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তবে চাহিদা অনুযায়ী দুধ সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না। রাজধানীর খামার ছাড়াও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো থেকেও রাজধানীতে দুধ আসছে। শুরুতে শখে গাভি পালন করলেও বছর না যেতেই এটিকে ব্যবসা হিসাবে নিচ্ছেন নগরের অনেকেই।

বিষয়ঃ বাংলাদেশ

Share This Article