সন্ত্রাস-সহিংসতায় গণতন্ত্রের ক্ষতি

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:২৯, সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৪ আশ্বিন ১৪২৯

রাজনীতিতে বাড়ছে সন্ত্রাস-সহিংসতা। রাজপথ দখলকে কেন্দ্র করে প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশে হামলা, নির্যাতন, মঞ্চ ভাঙচুর এবং নেতাকর্মীদের হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এই সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশকে দায়ী করছে বিএনপি। 

তবে আওয়ামী লীগ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দলের পাশাপাশি নেতাকর্মীদের উস্কানিমূলক অপতৎপরতার কারণেই দেশের কোথাও কোথাও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। বিশিষ্টজন বলছেন, এই দোষারোপের রাজনীতি, সন্ত্রাস ও সহিংসতা দেশকে পেছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে গণতন্ত্রের।

বিশিষ্টজন বলছেন, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যকার মতবিরোধ এবং একে অপরকে ঘায়েল করার প্রবণতা এতটাই বেড়েছে যে, তা প্রতিনিয়ত রাজপথে জন্ম দিচ্ছে রক্তাক্ত সংঘাত-সহিংসতার। কেউ কাউকে সহ্য না করার প্রবণতা ও নূ্যনতম সহনশীলতার অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। কাজেই এ থেকে উত্তরণে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত পূরণে সব পক্ষকে রাজনীতিতে পরমতসহিষুষ্ণ হতে হবে। ক্ষমতাসীন দলকে যেমন বিরোধীদের মতামত ও কথা বলার গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি সর্বোচ্চ সহনশীলতা দেখাতে হবে; তেমনি বিরোধী দলকেও উস্কানিমূলক তৎপরতা পরিহার করে চলতে হবে। তাদের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে আরও মনোযোগী হতে হবে।

রাজনৈতিক বিশ্নেষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা আরও বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে দেশে একটি সুস্থ-স্বাভাবিক রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।

ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, দেশে যে রাজনীতি চলছে, তা এককথায় বলতে গেলে বুর্জোয়াদের রাজনীতি। তারা ক্ষমতার জন্য এমনই দ্বন্দ্ব-সংঘাত-ফ্যাসাদে লিপ্ত হবে। এটাই স্বাভাবিক। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে এ ব্যবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কী? আমি বলব, বিকল্প রাজনীতি দরকার। এটা ছোট মুখে বড় কথার মতো শোনাতে পারে। তবে আমি মনে করি, এটাই দরকার।

তিনি আরও বলেন, আমি কোনো তৃতীয় রাজনীতির কথা বলছি না। বিকল্প রাজনীতি হলো, যে রাজনীতি হবে সমাজ বদলের রাজনীতি। মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গলের রাজনীতি। পুঁজিবাদী এই সমাজব্যবস্থা বদলে সমষ্টিগত সম্পদের মালিকানা দরকার; যাঁরা মনে করেন এই অসুস্থ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। ছাত্র সংসদগুলো কার্যকর করা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, আলাপ-আলোচনা, নাটক- এসবের মূল লক্ষ্য হবে রাজনীতির পরিবর্তন ঘটানো। সেই সঙ্গে পরমতসহিষুষ্ণতা ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা তো থাকতেই হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রাজনীতিতে এই সংঘাতময় পরিস্থিতি দেশ ও জনগণের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই এ অবস্থা পরিহারে দেশ, জনগণ ও অর্থনীতির দিকে তাকিয়ে হলেও সরকারি ও বিরোধী দলগুলোকে সংঘাতহীন রাজনীতির চর্চা করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, দেশের অর্থনীতির একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে মনে করি, অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতার রাজনীতিতে আসতে হবে। আর রাজনৈতিক এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোকেই নিতে হবে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ বলেন, সংঘাত-সহিংসতাময় বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রধানতম উপায় হচ্ছে, একে অপরের প্রতি গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ দেখানো এবং পরমতসহিষুষ্ণতা প্রদর্শন। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের প্রতিও প্রত্যেককে শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।

তিনি আরও বলেন, এখানে আরও একটি কথা বলা যায়, বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে সভা-সমাবেশ করা তথা রাজনীতির মাঠে নামার সুযোগ পায়নি। এখন তারা নামার সুযোগ পেলেও তাদের দলের মধ্যেও কিন্তু উগ্রপন্থিরা রয়েছে, যারা উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখে পরিস্থিতি আরও অসহনশীল করে তুলছে। তাদের সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে হবে। তবে বিগত দিনের কর্মকাণ্ডের কারণে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের আন্তঃসম্পর্কের মধ্যে এতটাই দূরত্ব ও তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে; সেটা স্বাভাবিক হতে আরও অনেক সময় লাগবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরমতসহিষুষ্ণতা তৈরি করা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো এবং সবার জন্য সুস্থ ও নিরাপদ রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। এ থেকে বিচ্যুতি ঘটলেই আসলে সংঘাত-সহিংসতার সৃষ্টি হয়। তাই সব রাজনৈতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে গণতন্ত্রের এই পূর্বশর্ত পরিপূরণে তাদের প্রত্যাশিত ও নির্ধারিত ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, এ ছাড়া গণতন্ত্রের পূর্বশর্তগুলো প্রতিপালন ও সঠিকভাবে কার্যকর করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদেরও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের নিরপেক্ষ ভূমিকা না থাকলে এই সংঘাত-সহিংসতার নমুনা বা দৃষ্টান্তগুলো আরও ঘনীভূত হবে।

Share This Article