'শিক্ষাঙ্গনে সর্বদাই অন্য রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মসূচি বন্ধ করতে চেয়েছিল শিবির'

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:১৩, শুক্রবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ২৫ ভাদ্র ১৪২৯

'এখনকার মতো তখন ক্যাম্পাসে ছিল না এত সিসিটিভি ফুটেজ। ছিল না কারো হাতে স্মার্টফোন। দিনে দুপুরে শত শত শিক্ষার্থীর সামনে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের কুপিয়ে হত্যা করত শিবির।

 ভয়ের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অথবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তায়, বরাবরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্য সকল ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি বন্ধের জন্য কাজ করেছে এই শিবির।' 

আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য সুফি ফারুক ইবনে আবুবকরের সঞ্চালনায় গুরুকুল লাইভ আয়োজিত 'ফিরে দেখা: শিক্ষাঙ্গনে শিবিরের বর্বরতা' শীর্ষক আলোচনার দ্বিতীয় পর্বে এভাবেই বিএনপি-জামায়াত শাসন আমলে শিক্ষাঙ্গনে শিবিরের ভয়াবহতার কথা জানান তৎকালীন ছাত্র নেতারা।

রাজশাহী জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক সময় শতভাগে শিবিরের ত্রাসের নিয়ন্ত্রণে ছিল এমন মন্তব্য করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক (২০০৯-১০) সাধারণ সম্পাদক ড. শাহ আলম সিদ্দিকী বলেন, আসলে ঢাকার সঙ্গে রাজশাহীর কোন তুলনাই চলে না। বিশেষত জামায়াত শিবিরের দখল ও অত্যাচারের ক্ষেত্রে রাজশাহীর প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তখন পরিচিত ছিল। ২০০৪ সালে আমি ভর্তি হই রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। জামায়াত-বিএনপি সরকারের মাঝামাঝি সময়। এর আগে আমাদের সিনিয়র যেই বড় ভাইরা ছিলেন, ২০০১ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়। কোন উপমা দিয়ে তা বোঝানো যাবে না। অনেককে শারীরিকভাবে মারাত্মক জখম করে। আর একাডেমিক তো আছেই। যারা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল, তারা কেউই হলে থাকতে পারেনি। বাহিরে ঘর ভাড়া করে থাকতে হতো। এতেও রক্ষা হয়নি। অনেককেই পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি। আর পাশ করার পরও অনেককে ইন্টার্নি করতে দেওয়া হয়নি। এমন অনেক নির্যাতন তারা করেছে।

তিনি বলেন, শিবিরের রগকাটা রাজনীতি পত্রিকায় সবাই পড়েছেন। বিশেষত রাজশাহীতে আমাদের নেতাকর্মীরা মারাত্মকভাবে এর ভুক্তভোগী। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি অনেকবার আক্রমণের শিকার হয়েছি। নতুন শিক্ষার্থীরা যখন ভর্তি হয় তখন ক্যাম্পাসে প্রতিটি ছাত্র সংগঠনের ব্যস্ততা বাড়ে। আমি রামেক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় এমনই এক ভর্তির সময় শিবিরের ১৫-২০ জন আমাকে মারধর করে। মাথার পেছনে আঘাত করে বেশি। যদি এখনো আমার মাথার পেছনে চুল সরান, দেখতে পাবেন, প্রায় ২০টির বেশি সেলাইয়ের দাগ রয়েছে। সে সময় সিটি স্ক্রিন রিপোর্টেও অবস্থা ছিলো বেশ ক্রিটিকাল। কিন্তু আল্লাহর রহমতে সেই যাত্রায় আমি বেঁচে যাই। যারা ছাত্রলীগ করতো তাদের পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়া হতো। ক্যাম্পাসে যেতে পারতাম না। ছাত্র জীবনে ৫টি মামলা আমার বিরুদ্ধে করা হয়। শিবিরের চারটি মামলা এবং ছাত্রদলের একটি।

২০০৯ সালেও যখন নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরও রাজশাহীতে চলমান ছিল শিবিরের এই নির্যাতন। এ বিষয়ে ড. শাহ আলম বলেন, শিবিরের রাজশাহীর প্রতিটি ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। ছাত্রদলও শিবিরের সামনে দাড়িয়ে থাকতে পারেনি। যদিও তারা ক্ষমতায় ছিল। ২০০৯-১০ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায়, তখনও ফারুক ভাইয়ের মত নেতারা লাশ হয়ে পড়েছিল ম্যানহোলে। বিষয়টা আসলেই মেনে নেওয়ার মত ছিল না। এছাড়া ছাত্র মৈত্রীর নেতা ছিলেন শহীদ জামিল আক্তার রতন। প্রকাশ্যে দিবালোকে শত শত শিক্ষার্থীর সামনে কুপিয়ে হত্যা করে তাকে শিবির।

রাতের অন্ধকারে শিবিরের হামলার স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, শিবির যখন হামলা করত, তখন হলের ওই ব্লকের সব আলো বন্ধ করে দিত। তাদের হাতে নিজস্ব আলো থাকত। এক ভীতিকর অবস্থা তৈরি করে অন্ধকারের মধ্যে হামলা চালাত তারা। অবশ্য তারা এই পুরো দেশকেই অন্ধকার রাজ্যে পরিণত করতে চেয়েছিল। সুতরাং এটি তাদের কাছ থেকে স্বভাবসুলভ আচরণ।

শিবিরের হামলার বিভীষিকার কথা নিজ স্মৃতি থেকে তুলে ধরছেন ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা দীপক পাল। তিনি বলেন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৮-৯৯ সেশনে আমি ভর্তি হই। আমাদের ক্যাম্পাসে জামায়াত শিবিরের কখনই এককভাবে রাজনীতি করার সুযোগ ছিল না। বিএনপির সময় ছাত্রদলের ঘাড়ে চরে তারা রাজনীতি করেছে। এর একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে ১৯৯৫-৯৬ সালে ছাত্রলীগ, ছাত্রদলসহ আরও বেশ কিছু ছাত্র সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে শিবিরকে এই ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে।

২০০১ সালের নির্বাচনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এক কেন্দ্র দখলের খবর পেয়ে আমরা যাই। সেখানে ভোট কারচুপি চলছিল। আমরা অনেকে এক সঙ্গে সেখানে গেলে প্রথমে জামায়াত শিবিরের ওরা পালিয়ে যায়। পরে ভিন্ন পথে তারা আক্রমণ করে। এ সময় আমাকে মারধর করে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায়। সেখান থেকে আমি বেঁচে ফিরি। তখন তো আমরা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। এরপর যখন আমরা ব্যান্ডেজ মাথায় পরীক্ষার হলে যাই। পুলিশের পাহারায় পরীক্ষা দিয়েছি কিছু। এরই মধ্যে পরীক্ষার হলের মধ্যে ঢুকে আমাদের বেশ কয়েকজনকে নির্যাতন করে এই শিবিরের নেতাকর্মীরা। পরীক্ষার হল থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আমাকে মারধর করে। এ সময় ক্যাম্পাসে তো কোনভাবেই আমরা থাকতে পারিনি। কোনমতে ময়মনসিংহ শহরে বাসা ভাড়া করে মাঝে মধ্যে ক্লাস করে, লুকিয়ে লুকিয়ে পরীক্ষা দিয়ে যেতাম। তারপরও ক্লাস, পরীক্ষার হল বা ক্যাম্পাসের যেখানেই পেতো, সেখানেই নির্যাতন চালাত তারা।

বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তন্ময় আহমেদ বলেন, আসলে শিবির বরাবরই এমনভাবে রাজনীতি করেছে যে তারা অন্য কাউকে রাজনীতি করতে দেবে না। সেটা অতীতে হোক বা বর্তমানে। রাজশাহী, চট্টগ্রাম বা ময়মনসিংহ সবখানেই তারা এভাবে কাজ করেছে। এই প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ তো বটেই ছাত্রদলকেও হামলা করেছে তারা অনেকবার। বিএনপির অনেকে বলে একই মায়ের পেটের দুই ভাই জামায়াত-বিএনপি। কিন্তু মাঠে ছাত্রদলকেও ছাত্র শিবিরের হামলার শিকার হতে দেখা গেছে। ছাত্রদলের নেতারা সবচাইতে বেশি নিহত হয়েছেন শিবিরের হাতে। ছাত্রলীগের ক্ষেত্রেও তাই। তবে বুয়েটে এই খুনের রাজনীতি ছিল না। বরং তারা যেটা করত, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকে ঘোষণা দিতো, এখানে কোন রাজনীতি হবে না। এরপর ভিতরে ভিতরে শিবির তাদের সব কার্যক্রম চালিয়ে যেতো।

তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রথম বর্ষে থাকতে শিক্ষকদের মধ্য থেকে অনেকে বলতেন, নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হলে তাদের ওরিয়েন্টেশনে রাজনৈতিক ব্যানারে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। রাজনৈতিক ব্যানারে যে কোন কার্যক্রম করতে অনুৎসাহীত করত তারা। তখন শিক্ষকরা যা বলেছেন শুনেছি। কিন্তু বছর যেতে না যেতেই টের পেলাম, ছাত্রলীগ তার ব্যানারে কিছু না করলেও ছাত্র শিবির চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কার্যক্রম। এ বিষয়ে ওই শিক্ষকদের কোন আপত্তি নেই। এভাবেই আসলে তারা পৃষ্ঠপোষকতা করেছে শিবিরের। শুধু তাই নয়, মেধাবী শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের করে নেয়ার চেষ্টা করে যেতো এই জামায়াত শিবির।

শিবিরের নৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে তন্ময় আহমেদ বলেন, শিবির আজ নৈতিকতার কথা বলে! আমি বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হবার আগে বা পরে সব সময় রুম শেয়ার করে থেকেছি। আর শিবিরের এক ছেলেকে আমরা পেয়েছি একাই একটা রুম দখল করে রেখেছে। আর সেখান থেকে বিভিন্ন ধরণের অবৈধ দেশ বিরোধী কাজ করে গেছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শিক্ষকরা সরাসরি ভয়ভীতি প্রদর্শন করত এমন মন্তব্য করে তন্ময় আহমেদ বলেন, আমাদের বলা হতো, যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসে তখন কি করবে? মজাদার বিষয় হলো- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকা অবস্থায়ই আমাদের বুয়েটে রাজনীতির শুরু।

শিবিরের হামলায় ছাত্রলীগ নেতা দীপকে হত্যার কথা স্মরণ করে তন্ময় আহমেদ বলেন, দীপ হত্যার বিচার আজও হয়নি। আমার ওপরও হামলা চালায় শিবির। কুপিয়ে জখম করে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায়। এখনও শত শত সেলাইয়ের দাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি।

Share This Article