৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি আজিজ এখন কোথায়

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ দুপুর ০১:২৭, বুধবার, ৩ আগস্ট, ২০২২, ১৯ শ্রাবণ ১৪২৯

মেহেদী হাসান খাজা

শীর্ষ ঋণখেলাপি জাজ মাল্টিমিডিয়ার আব্দুল আজিজের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে জনতা ব্যাংক ও দুদকের। গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও আছে তার বিরুদ্ধে। তারপরও তিনি দিব্যি ঢাকা শহর চষে বেড়াচ্ছেন। অথচ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে খুঁজে পাচ্ছে না!

 

অবশ্য পুলিশ নানা যুক্তি দিয়ে বলছে, কোনো পলাতক আসামি যদি এভাবে ঘোরাঘুরি করে তাহলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। তবে আব্দুল আজিজ হয়ত নিজের ইচ্ছাই পলাতক রয়েছেন। পুলিশ বলছে, হতে পারে আজিজের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট রয়েছে এক এলাকায়, কিন্তু বসবাস করছেন অন্য এলাকায়। তা ছাড়া মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হয়ত তাকে খুঁজে পাচ্ছেন না, যার কারণে গ্রেপ্তারও হচ্ছে না। যদি আজিজের বিরুদ্ধে আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থেকে থাকে তাহলে যে কোনো সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হবে।

অন্যদিকে পুলিশেরই একাধিক সূত্র বলছে, আজিজ পলাতক আসামি এবং তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও রয়েছে। হয়ত সেটা উধাও হয়ে গেছে। কিংবা এসব কেলেঙ্কারি থেকে রেহাই পেতে তিনি ব্যাংক অথবা বড় রাজনৈতিক কোনো ব্যক্তিকে ধরেছে।

আর আব্দুল আজিজ ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেছেন, ‘জনতা ব্যাংকের সঙ্গে আমার সমস্যা প্রায় সমাধান হয়ে গেছে। এখন আর এ বিষয়ে আপাতত তেমন কিছুই নেই। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা অনর্থক বলে আমি মনে করি। সংবাদ প্রকাশ না করাই ভালো। প্রয়োজনে আমাদের অফিসে দেখা করে এবং সিনেমা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করুন। এতে করে দেশের সিনেমা অঙ্গনের ভালো হবে।’

আজিজের আদ্যোপান্ত

ঢাকাপ্রকাশ’এর অনুসন্ধানে জানা যায়, আব্দুল আজিজ মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়ার একটি বাসায় বসবাস করছেন। প্রকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খাচ্ছেন, আড্ডা দিচ্ছেন। তিনি প্রতিদিনই নিউ ইস্কাটনে আবির হাসপাতালের গলিতে জাজ মাল্টিমিডিয়ার অফিসেও বসছেন।

জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজের ব্যবসায়িক পরিচিতি এমএ আজিজ। বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত আজিজ বাংলাদেশের শীর্ষ ঋণখেলাপি। তিনি ভুয়া রফতানির নথি তৈরি করে জনতা ব্যাংক থেকে পাঁচ বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। একারণে তার নামে ঋণখেলাপির মামলা রয়েছে। আজিজ মূলত ক্রিসেন্ট গ্রুপের মালিক। পাশাপাশি তিনি জাজ মাল্টিমিডিয়ার মালিক। যার মাধ্যমে দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন।

২০১১ সালে ভালোবাসার রং সিনেমা দিয়ে জাজের যাত্রা শুরু। দেশের ৪২০টা সিনেমা হলের মধ্যে ৪০০টি হলে নিজেদের ডিজিটাল মেশিন বসিয়ে হলগুলো দখলে নেন। এরপর একের পর এক ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে থাকে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি। এরমধ্যে- নবাব, শিকারি ও অগ্নি, বস ২, পোড়ামন-১, পোড়ামন-২, বাদশা-দ্য ডন’র মতো বেশ কিছু আলোচিত সিনেমা রযেছে।

শীর্ষ ঋণখেলাপি আবদুল আজিজকে অনেকেই মিডিয়া অঙ্গনের মাফিয়া বলেন। ২০১৩ সালের দিকে ভালোবাসার রং সিনেমার জন্য সুপারস্টার নায়ক শাকিব খানকে নির্বাচন করে। কিন্তু শাকিব খান সিনেমাটি করতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে হত্যার জন্য এফডিসিতে অস্ত্র ধরে আজিজের বন্ধু মনোয়ার এহতেশাম ওরফে শীষ। তখন শাকিব খানকে মাফ করে দেওয়ার জন্য হস্তক্ষেপ করে পরিচালক শাহিন ও সুমন। তারা শীষকে বলেন ‘ভাই ওরে মাফ কইরা দেন। ও মরে গেলে চলচ্চিত্র শেষ হয়ে যাবে’।

জানা যায়, আজিজ মিডিয়াতে প্রবেশের পর প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ী রাখতে নারাজ ছিল। প্রভাব খাটিয়ে আজিজ যাকে তাকে তৈরি করেছেন নায়ক ও নায়িকা। নিজের পছন্দ হলেই তিনি নায়িকা বানিয়ে নেন।

জাজ মাল্টিমিডিয়ার তথ্য মতে জানা যায়, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রযোজনায় তৈরি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রেও বিনিয়োগ করেছে তারা। মাহি, নুসরাত ফারিয়ার মতো নায়িকার উত্থান এ প্রতিষ্ঠানের হাতেই। শাকিব খানের ব্যবসা সফল অনেক চলচ্চিত্রও জাজের ব্যানারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আজিজ পারিবারিকভাবে পুরান ঢাকার চামড়া ব্যবসায়ী। জাজ মাল্টিমিডিয়ার চেয়ারম্যান আবদুল আজিজের বড় ভাই এমএ কাদের। তিনিও কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত, পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও রফতানিকারক একাধিক প্রতিষ্ঠানের মালিক। আজিজ ও তার ভাই এমএ কাদেরের বেশ কয়েকটি কোম্পানি রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে- ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্টস, ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ, ক্রিসেন্ট ফুটওয়্যার, রূপালী কম্পোজিট লেদার, লেক্সকো লিমিটেড ও গ্লোরি অ্যাগ্রো অন্যতম। সবগুলো প্রতিষ্ঠানই গড়ে তোলা হয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপের নামে। গ্রুপটির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে রয়েছেন এমএ কাদের। আর রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের চেয়ারম্যান এম এ আজিজ।

পৈতৃক সূত্রে পাওয়া চামড়াজাত পণ্যের ব্যবসায় দুই ভাইকে ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। ২০১৩ সাল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরে জনতা ব্যাংক পাঁচ হাজার ১৩০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এম এ কাদের ও এম এ আজিজকে। শুধু এ ঋণের টাকা নয়, এমএ আজিজ পণ্য রফতানির বিপরীতে নগদ সহায়তা তহবিল থেকে তুলে নেন আরও এক হাজার ৭৫ কোটি টাকা। বর্তমানে এই দুই ভাইয়ের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা দুই হাজার ৭৬০ কোটি টাকা।

রিমেক্স ফুটওয়্যারের মাধ্যমেই অর্থ কেলেঙ্কারি

ক্রিসেন্ট গ্রুপ কেলেঙ্কারির বড় অংশই হয়েছে জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার এম এ আজিজের মালিকানাধীন রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে জনতা ব্যাংকের হাজার কোটি টাকার বেশি পাওনা রয়েছে। এসব পাওনা টাকা পরিশোধ না করায় আজিজের নামে মামলা করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।

মামলায় জনতা ব্যাংক দাবি করে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকাই জাজ মাল্টিমিডিয়ার অর্থের মূল উৎস। রিমেক্স ফুটওয়্যার নামে একটি অখ্যাত চামড়াজাত পণ্যের কোম্পানির মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে এ অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে।

২০১৯ সালের ৩১ জুলাই রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের চেয়ারম্যান এম এ আজিজের নামে একটি চিঠি ইস্যু করে জনতা ব্যাংক। ওই চিঠিতে এমএ আজিজের ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করা হয়, হাউজ নং-৫৩৬, রোড নং-১১, বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি, আদাবর-১১, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

ব্যাংকটির বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের (এফটিডি) উপমহাব্যবস্থাপক মো. রুহুল আমীন খান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, অবিলম্বে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করুন অন্যথায় ব্যাংক আপনার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পরে আজিজ ব্যাংকের লোকদের বলেন, আমি জাজ মাল্টিমিডিয়ার আব্দুল আজিজ। এম এ আজিজ নয়, আপনারা ভুল করছেন। এরপর এ ঘটনায় জনতা ব্যাংক আদালতে মামলা করেন। এ মামলায় আজিজ বেশ কয়েক বছর কানাডায় পালিয়ে ছিলেন। যদিও আজিজের দাবি, তিনি ব্যক্তিগত কারণে দেশের বাইরে ছিলেন।

আছে বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগও

এদিকে আবদুল আজিজসহ তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ৯১৯ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের। তার নামে একটি মামলাও করেছে সংস্থাটি। সেটি এখন তদন্তাধীন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের তদন্ত কর্মকর্তা (প্রটোকল) মো. শফিকুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, জাজের আজিজের বিরুদ্ধে শুল্ক গোয়েন্দার একটি মামলা রয়েছে। সেটির তদন্ত চলমান।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, আজিজের নামে দুদকেও দুটি অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, তার নামে এক হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের এবং জনতা ব্যাংকের তিন হাজার ৫৭২ কোটি টাকা ফেরত না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

দুদক উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ আরিফ সাদেক সোমবার (১আগস্ট) ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, জাজ মাল্টিমিডিয়ার পরিচালক আজিজের অভিযোগের বিষয়ে ফাইল দেখে খোঁজ খবর নিয়ে বিস্তারিত জানানো যাবে। তাছাড়া এখন আমি একটা মিটিং এ আছি। আপাতত কিছু বলতে পারছি না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আব্দুস ছালাম আজাদ ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, এ বিষয়টি বর্তমানে আইনের আওতায় রয়েছে। আইনগত ভাবে বিষয়টি দেখা হচ্ছে। তবে, আমাদের ব্যাংকের যারা আজিজকে ঋণের জন্য সহযোগিতা করেছিল তাদের বিরুদ্ধে আমরা অফিসিয়ালি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। তিনি বলেন, এতটুকু বলতে চাই এ বিষয়ে আমরা একটি যৌক্তিক সমাধানের পথে রয়েছি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার এডিসি মোহাম্মদ সজল ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, তার বাসা কোন এলাকায় এবং কোন এলাকায় তার নামে ওয়ারেন্ট এ বিষয়টি পরিস্কার করে বলতে পারছি না। আপনাদের কাছে কোন তথ্য থাকলে পুলিশকে সহায়তা করুন। এ বিষয়ে আমি মোহাম্মদপুর থানায় খোঁজ খবর নিচ্ছি ।

এ বিষয়ে মোহাম্মাদপুর থানায় যোগাযোগ করলে সংশ্লিষ্ট ডিউটি কর্মকর্তা জানান, আজিজের নামে আমাদের থানায় এখনো কোনো ওয়ারেন্ট আসেনি। তাছাড়া তিনি কোন মামলার আসামি সেটা এখন আমরা বলতে পারছি না তবে খোঁজ নিচ্ছি।

আব্দুল আজিজ রমনা থানা এলাকায় নিউ ইস্কাটন রোডে জাজ মাল্টিমিডিয়ার অফিসে প্রায় প্রতিদিন অফিস করছেন। কিন্তু পুলিশ তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। জানতে চাইলে রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, আব্দুল আজিজের অফিস আমরা আপাতত চিনতে পারিনি। তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে এটা প্রমাণিত হলে বা মোহাম্মদপুর থানা আমাদের ক্লিয়ারেন্স দিলে আমরা তাকে অবশ্যই গ্রেপ্তার করে ওই থানায় হস্তান্তর করব।

জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হাফিজ আল আসাদ ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, আব্দুল আজিজ কেন, যে কেউ পলাতক আসামি হলে তাকে অবশ্যই গ্রেপ্তার হবে। সাধারণত এ ধরনের আসামিরা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় বসবাস করে, যার কারণে ধরতে একটু অসুবিধা হয়। হয়ত আজিজের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়েছে।

আর পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, আব্দুল আজিজ পলাতক রয়েছে কিনা সে বিষয়ে আপাতত তথ্য দিতে পারছি না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আব্দুল আজিজ বলেন, ‘আপনি যেসব কথা বললেন ঘটনা সেটা নয়। আমি শীর্ষ ঋণখেলাপী ব্যক্তিও নই। তাছাড়া জনতা ব্যাংকের সমস্যা সমাধানের পথে। আমি কোনো ওয়ারেন্টেরও আসামি নই।’

আপনি জামিনে আছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সেটাও না। এসব নিয়ে নিউজ করার দরকার নেই। সরাসরি আমার অফিসে আসেন এবং সিনেমা নিয়ে কথা বলেন। আশাকরি সিনেমা নিয়ে কথা বললে ভালো হবে।’

তিনি বলেন, বর্তমানে আমি একটি শুটে আছি পরে ফ্রি হয়ে আপনাকে ফোন দিচ্ছি নিউজ করার দরকার নেই।

Share This Article