বন্যার কারণে আমন চাষে বিলম্ব, ফলন কমার শঙ্কা

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:২৯, শনিবার, ১৬ জুলাই, ২০২২, ১ শ্রাবণ ১৪২৯

দুই দফা বন্যার কারণে সিলেট ও সুনামগঞ্জে সময়মতো আমনের আবাদ শুরু করা যায়নি। এখন পানি কমলেও মাটি পুরোপুরি শুকায়নি। কিছু কিছু এলাকায় পানি এখনো নামেনি। কুড়িগ্রামে তীব্র তাপপ্রবাহে মাটি শক্ত হয়ে গেছে।

এই অবস্থায় বীজতলা তৈরিসহ ক্ষেতে চারা লাগাতে অনেক সময় লাগবে। এই বিলম্বের কারণে আমনের ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা।

 

অবশ্য ক্ষতি পোষাতে সিলেটে পরমাণু কৃষি গবেষণার উদ্ভাবিত ‘বিনা ধান সেভেন’ চাষের পরামর্শ দিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। ৫৭ বা ৫৮ জাতের ধান লাগানোরও পরামর্শ আছে। সুনামগঞ্জে বিলম্বে ফলন হয় এমন প্রজাতির বিআর ২২, বিআর ২৩ ধান আবাদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এদিকে কুড়িগ্রামে পরবর্তী বন্যার আশঙ্কায় আমনের আবাদ করবেন কি না, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন কৃষক।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম বলেন, জুন মাস থেকে শুরু হয় চারা করা। আগস্ট মাসের মধ্যে করলে আমন ধান হবে। কিন্তু কিছু কিছু জাতের আমন ধান আছে, যেগুলো আবার সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা যায়। তবে এর ফলন বেশি হয় না। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি বিলম্ব হলে কী কী সমস্যা হতে পারে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রতি হেক্টরে ৫০০ কেজির মতো ধান কম হবে। বিঘাপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ কেজি করে কমে যাবে। সঙ্গে তিনি যোগ করেন, হাওর অঞ্চলের নিচু জায়গায় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমন করা যাবে। তবে সেই জমির পরিমাণ খুব বেশি নয়।

সিলেটের বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোর কৃষক, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা এবং কৃষি ও ধান নিয়ে কাজ করছেন এমন একাধিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জুন মাসে আমন ধানের চারা করার সময় থাকলেও সিলেটে বন্যার কারণে এক মাসের বেশি দেরিতেও অনেক জায়গায় বীজতলা তৈরির কাজই শুরুই করা হয়নি। অনেক স্থানে বন্যার পানি থাকায় কত দিন পর বীজতলা তৈরির কাজ শুরু করা যাবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। বন্যায় বীজ নষ্ট হওয়ায় উপজেলা পর্যায়ে কৃষকের হাতে বীজ নেই। টাকা দিয়েও পাচ্ছেন না ভালো মানের বীজ। অন্যদিকে বেশি দেরিতে আমন চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৫০০ কেজি ধান কমে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। সঙ্গে পরবর্তী মৌসুমের বোরো ফলনও ঝুঁকিতে পড়বে।

সিলেটের সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলার অনেক জায়গায় এখনো নামেনি বন্যার পানি। উপজেলার কাজলসার ইউনিয়নের নওয়া গ্রামের কৃষক এবাদুর রহমান নিজের ৮০ একর জমিতে মৌসুমি ধান চাষ করেন। চলতি বন্যায় তাঁর সংগ্রহের বীজ নষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণে অল্প সময়ের মধ্যে এবার আমন চাষ করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন তিনি। এবাদ বলেন, ‘আমার বীজতলা পুরোটাই পানিতে ডুবে সব বীজ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন জমিতে ধান চাষের জন্য যে পরিমাণ বীজ প্রয়োজন তার ১০ ভাগের এক ভাগও হাতে নেই। বন্যার পানিতে পলির সঙ্গে বালুমাটি উঠে যাওয়ায় জমি উৎপাদনক্ষমতা হারাতে বসেছে। ধান চাষ করলেও আনুমানিক ৭০ শতাংশ জমিতে বালুমাটির কারণে ভালো ধান হবে না। ’

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর পশ্চিম ইউনিয়নের ঘোড়ামারা গ্রামের কৃষক মাখন মিয়া (৫৯) বলেন, ‘আমনের ক্ষেত করার জন্য বীজধান ঘরে সংরক্ষণ করে রেখেছিলাম। বন্যার পানিতে ঘরের বীজধান, চালসহ সব কিছু ভেসে গেছে। এখন নতুন করে বীজধান ক্রয় করতে হবে। তারপর আমন ধানের বীজতলা তৈরি করে আমন ধান রোপণ করতে হবে। কিন্তু উপজেলায় কোথাও ভালো মানের বীজধান পাচ্ছি না। এদিকে সময়ও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। তাই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে আছি। অন্য বছর আষাঢ় মাসের শেষ দিকে বীজতলা থেকে ধানের জালা তুলে রোপণ করে ফেলতাম। এ বছর এখনো বীজতলাই তৈরি করতে পারিনি। ’

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব ও হাওর কৃষি বিভাগের অধ্যাপক নূর হোসেন মিঞা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখনো অনেক জমিতে পানি আছে। বীজতলা কোথায় করবে? চারা গজাতে হবে তো। তারপরে রোপণ। তার মানে কমপক্ষে ২০ দিনের আগে চারা রোপণ করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে শর্ট ডিউরেশন ভ্যারাইটির (স্বল্প সময়সীমার জাত) যেসব ধান হয়, অর্থাৎ যেগুলো ১২০ থেকে ১৩০ দিনে পাকে, সেগুলো রোপণ করতে হবে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের ১৫ তারিখ পর্যন্ত লাগানো যাবে। তবে উঁচু জায়গায় লাগাতে হবে। ’

যদি আগস্টের ১৫ তারিখের মধ্যে লাগানো না যায় সে ক্ষেত্রে কী করণীয়—এমন প্রশ্নে নূর হোসেন বলেন, ‘যদি দেরি হয়ে যায় তাহলে চারার সংখ্যা বেশি দিতে হবে। দু-তিনটি চারা দেওয়া হয় একটি গোছায়। যদি দেরি করে লাগানো হয় তাহলে এই চারার সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে এক গোছায় আট থেকে ১০টি চারা লাগাতে হবে। কারণ এসব এলাকায় তাপমাত্রা আগে নেমে যায়। এতে ফুল হতে সমস্যা হয়। ঘন করে লাগালে তাপমাত্রা নেমে গেলেও ফুল আসতে সমস্যা হবে না। দেরিতে লাগালে পরমাণু কৃষি গবেষণার উদ্ভাবিত বিনা ধান সেভেন লাগানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এটি ১২০ দিনে পাকে। এ ছাড়া ৫৭ বা ৫৮ জাতের ধান লাগানো যেতে পারে। ’

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলায় ৮১ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। চলতি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত আমনের বীজতলা তৈরির শেষ সময়। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে বীজতলা তৈরি করতে হয়। কিন্তু এখনো আমনের বীজতলা পানিতে ডুবে থাকায় মাত্র ৪৮০ হেক্টর বীজতলা তৈরি হয়েছে। এই সময় পর্যন্ত চার হাজার ৩০০ হেক্টর বীজতলার মধ্যে ৯০ শতাংশ বীজতলা তৈরি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার সিকিভাগও পূর্ণ না হওয়ায় আমন চাষাবাদ হুমকিতে পড়বে—এই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই কৃষকদের বিলম্বে ফলন হয় এমন প্রজাতির বিআর ২২, বিআর ২৩ ধানের বীজতলা তৈরি করতে বলা হয়েছে। এই বীজ আগস্ট মাস পর্যন্ত তৈরি করা যায়। তবে এতে ফলন কিছুটা কম হতে পারে।

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নারকিলা গ্রামের কৃষক মহসিন মিয়া বলেন, ‘আমাদের এলাকার মধ্যে নারকিলা, মুছাপুর, ফয়জুল্লাপুর, ভেরাডহর, প্রতাপপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে আমন বা রোয়াতি ধান চাষ করা হয়। এবার চাষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ এখনো আমাদের বীজতলা বন্যার পানিতে ডুবে আছে। ১০ থেকে ১২ দিন বাদে পানি কমার পর আর বীজতলা তৈরির সময় থাকবে না। তখন আমাদের কেউ কেউ হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জসহ বাইরের জেলা থেকে আমন বীজের চারা এনে কিছু জমি চাষাবাদ করতে পারে। ’

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সালাহ উদ্দিন কায়সার টিপু বলেন, ‘সুনামগঞ্জে ভয়াবহ বন্যার কারণে আমন ও আউশ ধান চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। আউশের ক্ষতি হয়েছে। এখন পানির কারণে বীজতলা তৈরি ও বীজ ফেলা যাচ্ছে না। আমরা কৃষকদের দেরিতে পাকে এই প্রজাতির ধানের বীজতলা তৈরি আহ্বান জানাচ্ছি। ’

কুড়িগ্রামে তীব্র দাবদাহে মাঠ শুকিয়ে যাওয়ায় অনেকেই রোপণ করতে পারছে না আমন চারা। এর ফলে বেড়ে যাচ্ছে চারার বয়স। এতে উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা কৃষি বিভাগের।

জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় চলতি মৌসুমে এক লাখ ১৯ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হলেও গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত মাত্র ১৫ হেক্টর জমিতে রোপণ করা হয়েছে আমন চারা। সরেজমিনে রাজারহাট উপজেলার কিংছিনাই, নামা জয়কুমর ও কালুয়ারচরের বন্যাকবলিত এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে শোনা গেছে আমন আবাদ নিয়ে হতাশার কথা।

নামা জয়কুমর গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন জানান, ৩৫০ টাকা কেজি দরে পাঁচ কেজি হাইব্রিড ধানবীজ কিনে বপন করেছিলেন। বন্যায় পুরোটাই নষ্ট হয়েছে। টাকার অভাব আর নতুন করে বন্যায় ভয়ে হাত গুটিয়ে বসে আছেন এই ক্ষুদ্র কৃষক। একই গ্রামের কৃষক মোস্তফা মিয়া ২০ কেজি গুটি স্বর্ণা জাতের ধানবীজ বীজতলায় ফেলেছিলেন। সবটাই খেয়ে ফেলেছে বন্যা। এখন নতুন করে বীজতলা তৈরির জায়গা খুঁজছেন। এতে পিছিয়ে যাচ্ছে আবাদ।

এদিকে টানা দুই সপ্তাহের তাপপ্রবাহে জমিতে জমে থাকা পানি শুকিয়ে গেছে। অনেক কৃষক আমন চারা রোপণ করতে পারছেন না পানির অভাবে। পরবর্তী ফসল হিসেবে আলু চাষ করতে যাঁরা আগাম ধান রোপণ করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা বিপাকে পড়েছেন। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার গয়ারী গ্রামের কৃষক মো. শাহ আলম জানান, তাঁর ২৫ শতাংশ জমিতে এক দফা চাষ দিলেও এখন পানি শুকিয়ে যাওয়ায় চারা রোপণ করতে পারছেন না।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, পানির অভাবে অনেকেই চারা রোপণ করতে পারছেন না। চারার বয়স ৪০ দিন পেরিয়ে গেলে ফলন কমে যায়। তাই বরেন্দ্র ও বিএডিসি কর্তৃপক্ষকে সেচযন্ত্র চালু করে সম্পূরক সেচ দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা। ]

Share This Article