সরকার এখন পরিকল্পিত লোডশেডিং দিচ্ছে : অধ্যাপক ম তামিম

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ বিকাল ০৪:২২, বুধবার, ৬ জুলাই, ২০২২, ২২ আষাঢ় ১৪২৯

সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্যুৎবিভ্রাট দেখা দিয়েছে। লোডেশেডিং চলছে সর্বত্র। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বর্তমান সংকট এবং ভবিষ্যত পরিস্থিতি নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ম তামিম।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এখন গভীর সংকটে পড়েছে। এমন পরিস্থিতির জন্য তো আগেই সতর্ক করা হয়েছিল, তাহলে কেন এমন হলো?

ম তামিম : এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, আগে থেকেই শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। এতে লোডশেডিং করতে হতে পারে, এটাও বলা হয়েছিল। শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নত বহু দেশ জ্বালানি সংকটে পড়েছে। কেউ প্রস্তুত ছিল না। ইউরোপ মারাত্মক সংকটে পড়েছে। রাশিয়ানির্ভরতা তাদের বিপদে ফেলেছে। তারা কখনো ভাবেনি, রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। যুদ্ধ এসে পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে। জাপান, তাইওয়ান, ভারতেও সংকট দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন দেশে মানুষ বিক্ষোভ করছেন।
তবে বাংলাদেশের কিছু জায়গায় সুযোগ ছিল। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ৬০ কোটি ঘনফুট বাড়ানো অসম্ভব কিছুই না। কিন্তু এটা করা হয়নি। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন তো উৎপাদন বাড়িয়ে আর কমতে দেয়নি। দেশীয় কোম্পানি এটা করেনি।

দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর দিকে এখন জোর দেওয়া হচ্ছে। এটা কী আগে করার সুযোগ ছিল না?

ম তামিম : আগামী তিন বছরের মধ্যে দিনে অতিরিক্ত প্রায় ৬২ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের প্রকল্প নিয়েছে পেট্রোবাংলা। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে তারা এটা বাড়াবে। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমার বিষয়টি তারা পাঁচ বছর আগে থেকেই জানে। গত কয়েক বছরে কমছে। তারা এটা ধরে রাখার চেষ্টা করেনি। অথচ বিশ্বের সব দেশ উৎপাদন অন্তত ১০ বছর সর্বোচ্চ পর্যায়ে ধরে রাখার চেষ্টা করে। এটি ধরে রাখার উদ্যোগ অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। তারা দেশে গ্যাস নেই ধরে নিয়ে আমদানির দিকে ঝুঁকেছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) দিয়ে ঘাটতি পূরণের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছে।

এখন তো এলএনজির দাম চড়া, তাই আমদানি কমেছে। এ কারণেই তৈরি হয়েছে বর্তমান সংকট, আপনি কী মনে করছেন?

ম তামিম : নিজস্ব গ্যাস উৎপাদনে অনীহা ও আমদানিনির্ভর নীতিটা সব সময় খুব ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আমদানিতে গেলে সরবরাহ ও মূল্যঝুঁকি থাকবেই। এটা কখনোই পূর্বাভাস করা যায় না। যে কোনো কারণে তেল, গ্যাসের দাম বিশ্ববাজারে বাড়তে পারে। বিভিন্ন সময় তেলের দাম বেড়েছে, তা ছিল সাময়িক। এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে, এটা আরও কত দিন চলবে, তা আন্দাজ করাও মুশকিল। আর যুদ্ধ না হলেও বাংলাদেশ সংকটে পড়ত। জ্বালানি খাতে আমদানি নীতির ফল ভালো হয় না।
জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আত্মনির্ভরতা। পুরোটা না পারলেও যতটা পারা যায়, তার চেষ্টা থাকতে হবে। উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য এটা খুব জরুরি। বিশ্ববাজারের স্বাভাবিক সময়ে গ্যাসের দামই বাংলাদেশের জন্য বড় চাপ। তাই আমদানিনির্ভর না হয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত ছিল। জার্মানি , হাঙ্গেরি, কোরিয়া, জাপান আবার কয়লার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তারা নিরুপায় হয়ে এটা করছে। পরিবেশের দিক চিন্তা করেই বাংলাদেশেরও নিজ কয়লা উত্তোলনের কথা ভাবতে হতে পারে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকার পরও উৎপদন করা যাচ্ছে না, জ্বালানি সংকট বিদ্যুৎ খাতকেও ভোগাচ্ছে?

ম তামিম : উৎপাদন সক্ষমতার কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহের। বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি বড় অংশ আমদানি করা জ্বালানি দিয়ে। এলএনজি, জ্বালানি তেলের দাম অনেক বেড়ে গেছে। গ্যাস, জ্বালানি তেল সবই কেনা সম্ভব, কিন্তু খরচ অনেক বেড়ে যাবে। যুক্তরাজ্য, হাঙ্গেরির মতো দেশে দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে, দেশেও এটি দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। দ্বিগুণ না হয়ে ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানো হলেও এটা বিরাট চাপ গ্রাহকের জন্য। সরকার কিছু ভর্তুকি দিলেও বাড়তি ওই দাম গ্রাহক দিতে পারবে না।
তাই আমদানি কমিয়ে সাশ্রয়ের কথা ভাবছে সরকার। আর খরচ সাশ্রয়ে লোডশেডিং একটা টুলস সরকারের জন্য। এটি সাময়িক সময়ের জন্য কার্যকর হতে পারে। দাম বাড়ানো হলে অর্থনীতি চাপে পড়বে। তাই খরচ সাশ্রয়ে লোডশেডিং সরকারের জন্য সাময়িক একটা টুলস হতে পারে। লোডশেডিংয়ের বিকল্প হলো গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো। কোনোভাবেই দাম বাড়ানো যাবে না।

লোডশেডিংয়ে তো গ্রাহকের ভোগান্তি হচ্ছে, এটা কীভাবে কমানো যায়?

ম. তামিম : আগে তো লোডশেডিংয়ের কথা স্বীকার করত না। এখন সরকার পরিকল্পিত লোডশেডিং দিচ্ছে। আগে থেকেই গ্রাহককে লোডশেডিংয়ের সময় জানিয়ে দেওয়া উচিত। এতে গ্রাহক প্রস্তুতি নিতে পারবে। তবে শিল্পকারখানা, বিশেষ করে রপ্তানিমুখী উৎপাদন শিল্পে লোডশেডিং করা যাবে না।
লোডশেডিং করার মানে হলো সাশ্রয় করা এবং বিদ্যুতের দাম না বাড়ানো। দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। আবার শিল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখলেও অর্থনীতি চাপে পড়বে। যেসব কারখানায় সব সময় বিদ্যুৎ প্রয়োজন, তাদের অগেরাধিকার দিতে হবে বিদ্যুৎ সরবরাহে। আর লোডশেডিং করে সরকারের কী পরিমাণ সাশ্রয় হচ্ছে, তা–ও সবাইকে জানাতে হবে। এখন ব্যবস্থাপনা এমনভাবে করতে হবে, যাতে অর্থনৈতিক ধাক্কাটা কম লাগে।

Share This Article