পদ্মা সেতুর নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ দুপুর ০২:৪২, সোমবার, ২৭ জুন, ২০২২, ১৩ আষাঢ় ১৪২৯

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজতর করার লক্ষ্যে দেশের বৃহৎ নদীসমূহের ওপর দিয়ে সেতু নির্মাণ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাঁর সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালের ৪ জুলাই মানুষের স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ২০১৫ সালে দেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করার দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। 

জাতির আস্থার প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময় দেশের উল্লেখযোগ্য ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে মেধা, প্রজ্ঞা, সততা এবং নির্ভরশীলতার প্রতিফলন রেখে আসছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও কোন কোন কেপিআই-এর নিরাপত্তা কাজেও সেনাবাহিনী সম্পৃক্ত রয়েছে। যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর নিরাপত্তাকল্পে যেভাবে যমুনা পাড়ে গড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু সেনানিবাস সেভাবেই পদ্মার উভয় পাড়ে তৈরি হয়েছে শেখ রাসেল সেনানিবাস (মাওয়া-জাজিরা)। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে সেতু বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণশৈলীতে ইঞ্জিনিয়ার পরামর্শক নিয়োগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক সম্পাদিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তা দায়িত্বগুলো হলো- মাওয়া প্রান্তে ৭৭ বর্গ কি.মি. ও জাজিরা প্রান্তে ১৩২ বর্গ কি.মি. এলাকার নিরাপত্তা বিধান এবং সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে ৬ কি.মি. নদীপথ প্রত্যক্ষভাবে নজরদারিতে রাখা এবং সেতুর নির্মাণকাজ সংশ্লিষ্ট দেশী-বিদেশী ব্যক্তিবর্গ, শ্রমিক, আগত অতিথি এবং সরঞ্জামাদির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

সেতু কর্তৃপক্ষ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে চুক্তি


পদ্মা সেতুর ওপর নির্মাণকালীন এবং নির্মাণ পরবর্তী যে কোন ঝুঁকি বা হুমকি জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচ্য। সেতুটি শুধু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে সংযোগই করবে না, এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ককেও যুক্ত করবে। পায়রা ও মোংলা বন্দরসহ দক্ষিণের সকল উৎপাদনশীল কল-কারখানা, সংস্থা, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ জাতীয় অর্থনীতি উন্নয়নে অভাবনীয় ভূমিকা রাখবে। কাজেই বাংলাদেশের অহঙ্কার এবং জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নের বাহক এই বৃহৎ প্রকল্পের ওপর নির্মাণকালীন এবং নির্মাণ পরবর্তী নাশকতা পরিকল্পনার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া সমীচীন হবে না। প্রকল্পের শুরু থেকেই দেশী-বিদেশী (সর্বোচ্চ ১২৯৬ জন বিদেশী নাগরিক একই সময়ে ছিলেন) গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের ক্ষতিসাধন, প্রকল্প এলাকার ভেতর শ্রমিক অসন্তোষ, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অতিমূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী ও সরঞ্জামাদি পাচার অথবা ক্ষতিসাধন, সেতু সংলগ্ন অথবা নদীশাসন এলাকা হতে অবৈধ বালু উত্তোলন, ব্রিজের পিলারে নৌযানসমূহের ধাক্কা, প্রকল্প এলাকায় শ্রমিকদের মধ্যে মাদকের প্রভাব ইত্যাদি সম্ভাব্য ঘটনাসমূহ প্রকল্পের ওপর প্রত্যক্ষ হুমকি ছিল। এর পাশাপাশি পদ্মা সেতু প্রকল্প এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনা, প্রকল্পের মালামাল পরিবহনে যানজট এবং অবৈধ চাঁদা আদায়, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, শীতকালে নদীর নাব্য হারানোর মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজকে বিঘ্নিত করার সম্ভাবনা ছিল।

এ সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে এ নিয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়, যার উল্লেখযোগ্য অংশ হলো- মাওয়া ও জাজিরা এলাকায় স্থাপিত ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড ভূমিতে এবং নদীতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি এবং সরঞ্জামাদির নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্থায়ী নিরাপত্তা চৌকি ও অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করবে এবং দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় ২৪ ঘণ্টা টহল ও নৌ-টহল পরিচালনা করবে। মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে এবং নদীপথে যে কোন উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য একটি করে ইমার্জেন্সি রেসপন্স দল প্রস্তুত থাকবে এবং সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক প্রকল্প এলাকার বাইরে যে কোন অনভিপ্রেত ঘটনা যা সেতু প্রকল্পের নির্মাণ কাজে প্রভাব ফেলতে পারে তা নিরসনের জন্য সকল কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানকল্পে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সালে মাওয়া এবং জাজিরা প্রান্তে দুটি অস্থায়ী সেনানিবাস স্থাপন করা হয়। গত ২৯ মে ২০২২ তারিখ প্রধানমন্ত্রী জাজিরা প্রান্তে ‘শেখ রাসেল সেনানিবাস’ নামে একটি স্থায়ী সেনানিবাসের উদ্বোধন করেন। এই সেনানিবাস ভবিষ্যতেও পদ্মা সেতুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। চুক্তি অনুযায়ী সেনাবাহিনী যেসব দায়িত্ব পালন করছে এবং করবে তার মধ্যে রয়েছে- মাওয়া প্রান্তে অবস্থিত পদাতিক ব্যাটালিয়নটি মাওয়া প্রান্তে ১ নং পিলার হতে ধলেশ্বরী ব্রিজ পর্যন্ত ৭৭ বর্গ কি.মি. এবং জাজিরা প্রান্তের পদাতিক ব্যাটালিয়ন পদ্মা ব্রিজের ৪১ নং পিলার হতে পাঁচ্চর পর্যন্ত ১৩২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় দিনে ও রাতে সার্বক্ষণিক সরাসরি নজরদারির মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আসছে। রিভারাইন ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন ব্রিজের পূর্বে এবং পশ্চিমে ৬ কিলোমিটার নদীপথের নিরাপত্তা বিধান করে আসছে।

৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড প্রকল্প কাজে নিয়োজিত উর্ধতন দেশী-বিদেশী কর্মকর্তা/প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা, সমন্বয় এবং এলাকার জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের মাধ্যমে শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে খাবারের মান উন্নয়ন, সঠিক সময়ে বেতন-ভাতা প্রদান, সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে। শ্রমিকদের সার্বিক নিরাপত্তা, চিকিৎসা সহায়তা এবং সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে কোভিড ভ্যাকসিন আয়োজন, বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে কাজের সময় শ্রমিক সেফটি গিয়ার্সের অভাবে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা এড়াতে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে

প্রকল্প এলাকায় অগ্নিকান্ড রোধকল্পে অগ্নিনির্বাপণ সামগ্রী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে সংঘটিত অগ্নিকান্ডে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে এবং বড় ধরনের ক্ষতিসাধন থেকে জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। প্রকল্পের ছোটবড় অসংখ্য পাচারকারী (রড, লোহার এঙ্গেল, ব্যাটারি, ক্রেনের তার এবং তৈল চুরি) আটক করে এবং তাদেরকে পুলিশের নিকট হস্তান্তর করে। দেশী-বিদেশী নাগরিকগণের দ্বারা পদ্মা সেতুর ক্ষতিসাধন, প্রকল্প এলাকায় বিস্ফোরক স্থাপন, প্রকল্পের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার এবং বিদেশী প্রকৌশলীদের ক্ষতিসাধনসহ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা রোধকল্পে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে স্থলপথ ও নদীপথে (মূল সেতু বরাবর চ্যানেল শুরুর পূর্ব পর্যন্ত) প্রয়োজনীয় জনবলসহ টহল পরিচালনার মাধ্যমে অবৈধভাবে দেশী-বিদেশী প্রবেশকারীদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড। জেলা প্রশাসন, সেতু কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সমন্বয়পূর্বক পদ্মা বহুমুখী সেতু এলাকায় নদীপথে প্রভাব বিস্তারসহ বালু উত্তোলন, নদীতে ড্রেজিং, পাইলিং, নোঙ্গর করা ও প্রকল্প এলাকায় অবৈধ প্রবেশ রোধকল্পে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। টহল ও নিরাপত্তা জোরদারের মাধ্যমে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় মাদকদ্রব্যের (ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা) ব্যবসা সমূলে উৎপাটন করেছে সেনাবাহিনী। সেতুর কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের যে কোন দুর্ঘটনায় উদ্ধার করে এ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে হাসপাতালে প্রেরণ এবং চিকিৎসা কার্যক্রম নিশ্চিত করছে সেনাবাহিনী। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে যে কোন উদ্ভূত পরিস্থিতি তাৎক্ষণিক মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও জনবলসহ ইমার্জেন্সি রেসপন্স দল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রকল্প এলাকার ভেতরে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক জাজিরা ও মাওয়ায় সেতু সংলগ্ন এ্যাপ্রোচ রোড ও সার্ভিস এরিয়া এবং ঢাকা হতে মাওয়া ও জাজিরা হতে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ এবং যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেছে।

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানুষের একটি স্বপ্নের নাম- আজ এটি এক দৃশ্যমান বাস্তবতা। এটি জাতির সমৃদ্ধির প্রতীক। এই ধরনের একটি স্থাপনা রক্ষা করা আমাদের সকলের পবিত্র দায়িত্ব। সেতুর সার্বিক নিরাপত্তায় পেশাদার ও দেশপ্রেমী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা তাই একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। এছাড়াও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পদ্মা সেতু রেল লিঙ্ক প্রজেক্টের কাজ এখনও চলমান রয়েছে। শুধু সেতু নির্মাণকালীন নয়, পরবর্তীতে পদ্মা সেতু উদ্বোধন ও সেতুর নিরাপত্তার দায়িত্বে বাংলাদেশের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সেনাবাহিনীর ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দৃঢ়প্রত্যয়ী। সকল প্রয়োজনে জাতির আস্থার প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সদা তৎপর ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ সেতু বিভাগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার প্রশাসন ও পুলিশ এবং অন্য সকল সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করতে পেরেছে বলে সকলের নিকট বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কৃতজ্ঞ। ভবিষ্যতেও দেশের যে কোন প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

লেখক: মামুন উর রশীদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি

Share This Article