যে দেশে জনসংখ্যার চেয়ে বেশি বন্দুক

  বাংলাদেশের কথা ডেস্ক
  প্রকাশিতঃ সকাল ১০:২৮, শুক্রবার, ২৭ মে, ২০২২, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার রক্ষা, সন্ত্রাস নির্মূলসহ নানা ইস্যুতে নৈতিক পুলিশের ভূমিকায় বেশ সক্রিয় যুক্তরাষ্ট্র। অথচ বিশ্বের অন্যতম পুরনো এই গণতান্ত্রিক দেশটিতেই মানবাধিকার পরিস্থিতি ও সন্ত্রাস এমনভাবে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে যে, ক্ষণে ক্ষণে তা প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের। 

দেশটির অবস্থা এমন যে, সেখানে মোট জনসংখ্যার চেয়ে এখন বন্দুকের সংখ্যা বেশি। যখন তখন দেশটির বিভিন্ন শহরে বিকারগ্রস্ত কিছু লোক বন্দুক হাতে বেরিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে মানুষ খুন করছে। তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না অবুঝ শিশুরাও। সর্বশেষ গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম অঙ্গরাজ্য টেক্সাসের ইউভালদে শহরের একটি স্কুলে ঢুকে সালভাদ রামোস নামে এক তরুণ গুলি করে খুন করেছে ১৯ শিশুসহ ২১ জনকে। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ একটি এমআর-১৫ রাইফেলসহ একাধিক ম্যাগজিন উদ্ধার করেছে। যেখানে বেশিরভাগ দেশেই এ ধরনের স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার কথা বিষয়টি কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১৮ বছর বয়সী রামোস ঠিকই তা জোগাড় করে নিজের সংগ্রহে রেখেছিল।

শুধু তাই নয় ফেসবুকের মতো একটি খোলা ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মেও রামোস বারবার তার হামলা পরিকল্পনা ও নিজের দাদিকে গুলি করে হত্যার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন বন্ধুর সঙ্গে। অথচ পুলিশ বা সরকার এ বিষয়ে আগে থেকে কিছুই করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত হামলার পর পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারাতে হয় রামোসকেও। যুক্তরাষ্ট্রে গত দশ দিনের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার নির্বিচারে গুলি চলল। অবস্থা এমনই সঙ্গিন যে, চলতি বছর দেশটিতে ২১২টি বন্দুক হামলার ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে শত শত মানুষ। শুধু আগ্নেয়াস্ত্রের কারণেই দেশটিতে বছরে প্রায় প্রাণ হারাচ্ছেন গড়ে ৩৫ হাজার মানুষ।

সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমসের মতো প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যমগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র সমস্যা কঠিন করে তোলার পেছনে অন্যতম দায়ী সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ধুয়া তুলে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট প্রত্যেক নাগরিককে নিজেদের কাছে বন্দুক রাখার অনুমতি দিয়েছে। যার ফলে যে কেউ চাইলেই খোলা বাজার থেকেই যথেচ্ছা অত্যাধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে পারছে। যদিও দেশটিতে প্রদেশভিত্তিক বন্দুক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইন রয়েছে। তবু সাধারণ মানুষের কাছে অস্ত্রের এই হাতবদল নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার।

গত ১৯ জুন ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেশটির প্রখ্যাত সাংবাদিক ক্রিস্টোফার ইনগ্রাহাম একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। যেখানে দেখানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি সাধারণ মানুষের হাতে চলে যাওয়া বন্দুকের সংখ্যা। ২০২০ সালের জনশুমারি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩৪ কোটি। অথচ জেনেভার গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের বৈশ্বিক ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র জরিপ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের হাতে চলে গেছে ৩৯ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০০ জন বাসিন্দাপিছু বন্দুকের সংখ্যা দ্বন্দ্ব-জর্জরিত ইয়েমেনের থেকে বেশি। শুধু ২০২০ সালেই দেশটিতে বন্দুক সহিংসতায় প্রাণ গেছে ৪৫ হাজারের বেশি মানুষের। দেশটিতে বন্দুক সংক্রান্ত বিভিন্ন সহিংসতা নিরসনে সরকারের বাৎসরিক খরচ হচ্ছে কোটি কোটি ডলার। এভরি টাউন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বলছে, বন্দুক সহিংসতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিপ্রতি এখন বাৎসরিক খরচ হচ্ছে অন্তত ৬৭ হাজার ডলার।

ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি একশ জনের কাছে গড়ে আগ্নেয়াস্ত্র আছে ১২০.৫টি। অথচ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে প্রায় ধ্বংসের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া ইয়েমেনেও প্রতি একশ জনে বন্দুক আছে গড়ে ৫২.৮টি। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখন যুক্তরাষ্ট্রের ৪২ শতাংশ পরিবারের কাছেই রয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। অর্থাৎ ৩৯ কোটি ৩০ লাখ অস্ত্র ভাগ হয়ে গেছে মাত্র ৫ কোটি পরিবারের মধ্যে।

আগ্নেয়াস্ত্র সন্ত্রাসে যুক্তরাষ্ট্র কতটা জর্জরিত ও অসহায় হয়ে পড়েছে তা প্রকাশ পায় টেক্সাসের স্কুলের ঘটনার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, ‘জাতি হিসেবে নিজেদের কাছেই আমাদের প্রশ্ন করা উচিত, ঈশ্বরের নামে কখন আমরা বন্দুকের বিরুদ্ধে দাঁড়াব। আমি ক্লান্ত ও বিরক্ত। আমাদের কিছু করতেই হবে। আমাকে বলবেন না যে, এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধে আমাদের কিছু করার নেই।’ বন্দুক নিয়ে সংবেদনশীল আইন পাসে কংগ্রেস সদস্যদের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য তিনি নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হোকুল বলেন, ‘আমি কোনোভাবেই ভেবে পাই না ১৮ বছর বয়সী কেউ কেন আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে পারবে। এটা কি বন্দুক কেনার সঠিক বয়স? আমরা বাফেলো এবং টেক্সাসে যা দেখলাম তা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। নিউইয়র্কবাসীকে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া পর্যন্ত আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারব না।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, ‘বাবা-মায়েরা তাদের বাচ্চাদের বিছানায় শুইয়ে গল্প ও গান শোনান। কিন্তু তাদের মনের মধ্যে চিন্তা থাকে আগামীকাল বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে আসার পর কিংবা খোলা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পর, তাদের সঙ্গে কী ঘটবে! বন্দুক হামলা আমাদের দেশকে পঙ্গু করে দিচ্ছে।’ তিনি মনে করেন, বন্দুক সহিংসতা বন্ধে যে কোনো ধরনের পদক্ষেপের জন্য ইতিমধ্যে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে।

Share This Article