পরিবেশবান্ধব, খরচ কম- উত্তরাঞ্চলে বাড়ছে কদর

হাজার বছর ধরে ঘোড়া মানুষের সঙ্গী। সবচেয়ে ভাল বন্ধু। যে কোন স্থানে মানুষের সহযোগিতা করে আসছে ঘোড়া। বর্তমান যুগে দেশের গ্রামাঞ্চলে ঘোড়ার কদর এখনও কমে যায়নি। বিশেষ করে উত্তরের কুড়িগ্রাম জেলা নদ-নদী বেষ্টিত হওয়ায় এখানে চর-দ্বীপচর রয়েছে ৪০৫টি।
এসব দুর্গম চরাঞ্চলে, প্রত্যন্ত গ্রাম কিংবা শহরে বেড়েছে ঘোড়ার গাড়ির সংখ্যা। স্বল্প খরচ আর ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থাতেও পরিবহনে সহজ হওয়ায় মানুষের আগ্রহ বাড়ছে এই ঘোড়ার গাড়ির প্রতি। এতে করে তৈরি হচ্ছে গ্রামীণ কর্মসংস্থান। প্রত্যন্ত চর-দ্বীপ চরগুলোতে প্রধান বাহন হয়েছে এই ঘোড়ার গাড়ি। মানুষ এবং পণ্য পরিবহনে ঘোড়ার গাড়ি এখনও প্রধান বাহন।
দেশের উত্তরের সীমান্তঘেঁষা জেলা কুড়িগ্রাম। বিখ্যাত ভাওয়াইয়া গান ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারী বন্দর’... জেলা কুড়িগ্রামে দিন-দিন বাড়ছে ঘোড়ার গাড়ির সংখ্যা। ইট-পাথর আর পিচঢালা পথে গাড়িয়াল ভাইয়ের গরুর গাড়ির চাকার শব্দ এখন আর কানে আসে না। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গরু কিংবা মহিষের গাড়ির দৃশ্য। শহর-গ্রাম কিংবা চরাঞ্চলে সর্বত্রই ঘোড়ার গাড়ি চলাচল সবার নজর কাড়ে। দুর্গম রাস্তায় কম খরচে পণ্য পরিবহনের সুবিধার কারণে বাড়ছে ঘোড়ার গাড়ি। শহর থেকে দুর্গম এলাকা থেকে সব ধরনের পণ্য আনা নেয়ায় সহজ হয়ে পড়ছে ঘোড়ার গাড়িতে। কৃষি নির্ভরশীল জেলায় ভারি কলকারখানায় না থাকায় কাজ থাকে না বছরের অধিকাংশ সময়। তাই স্বল্প ব্যয়ে সারা বছর আয়- রোজগারের পথ হয়ে উঠেছে এই ঘোড়ার গাড়ি। তাই তো দিনমজুর থেকে শুরু করে রিক্সা-ভ্যান চালকরাও ছুটছেন ঘোড়ার গাড়ির প্রতি। গরু বা মহিষের গাড়ি বানাতে খরচ পড়ে প্রায় দেড় থেকে দু’লাখ টাকা। অলিগলিতে গরু বা মহিষের গাড়িতে যেতে না পারায় তেমন আয়ও হয়না। এতে গরু-মহিষের গাড়িতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। মাটি, বালু পথে ঘোড়া দিয়ে চলাচলের সুবিধা হওয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ গরুর গাড়ির বদলে এখন ঘোড়ার গাড়ির প্রতি ঝুঁকছে বেশি। কেউ গরু বিক্রি করে বা ঋণ করে ৫০/৬০ হাজার টাকায় ঘোড়া কিনে ঘোড়ার গাড়ি তৈরি করে সংসার চালাচ্ছেন। কুড়িগ্রামে এক সময় গরুর ও মহিষের গাড়ির প্রচলন থাকলেও সময়ের বির্বতনে এই গাড়িগুলো হারিয়ে গেছে। এসেছে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন। স্থানীয়দের অভিমত গরুর চেয়ে ঘোড়ার খরচ অনেক কম। এমনিতেই চারণভূমির সঙ্কটের কারণ ঘাস পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে গরুর জন্য। আর ঘোড়ার জন্য তেমন ঘাস লাগে না। শুধু ছোলা ও ভুষি হচ্ছে ঘোড়ার খাবার। এ কারণে জেলার মানুষ ঘোড়া পালনে আগ্রহী হয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে ঘোড়া অনেক দ্রুত চলে। এতে তাদের সময়ও অনেক কমে যায়। কুড়িগ্রাম অঞ্চলের মানুষ এসব ঘোড়া নওগাঁ, নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিয়ে আসে। যদিও এখানে আজ পর্যন্ত ঘোড়ার খামার তৈরি হয়নি এ জেলায়।
কয়েকজন ঘোড়ার গাড়ির চালক জানান, আগে হালচাষ করতাম এখন ঘোড়ার গাড়ি চালাচ্ছি হাল চাষের চেয়ে ঘোড়ার গাড়িতে মোটামুটি চলা যায়। এই ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে আমরা চাল, বালু, গম, চিনা, ধান, কালাই, পাট সবকিছু উঠাই। একটা ঘোড়ার গাড়ি বানাইতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাগে আর গরুর গাড়ি বানাইতে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাগে। তাই দিন দিন ঘোড়ার গাড়ির চাহিদা বাড়ছে আমাদের গ্রাম অঞ্চলগুলোতে।
পাঁচগাছি ইউনিয়নের ছত্রপুর গ্রামের মোঃ আকবর আলী (৫২), দেলোয়ার হোসেন (৬৫) জানান, মাত্র দেড় যুগে জেলায় কয়েক হাজার ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু হয়েছে। এসব গাড়ি দিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মালামাল পরিবহন করে থাকে সাধারণ মানুষ। তারা আরও বলেন, এতে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ায় আয়ও বেড়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে ঘোড়ার গাড়ি এখন অপরিহার্য বাহনে পরিণত হওয়ায় এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক নিম্ন আয়ের পরিবারের জীবিকার পথ ফিরে পাওয়ার পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব এই বাহনটি স্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রপুর ইউপি সাধারণ সদস্য, রহিম আহমেদ জানান, চরাঞ্চল তাই এই এলাকার লোকের কাজ কর্ম অনেক কম থাকে বছরে দুই একবার কাজ থাকে। অল্প টাকায় ঘোড়ার গাড়িটা কেনা যায় তাই কেনার আগ্রহ বেশি। আর ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে বিভিন্ন মালামাল পরিবহন করে এবং বারো মাস এটা দিয়ে আয় করা যায়। এই জন্যই ঘোড়ার গাড়ির প্রচলনটা দিন দিন বাড়ছে।